পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫১৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(OO রবীন্দ্র-রচনাবলী তাহার পরে আবার এই নোটটুকুর জন্য এত সাবধান ! সকলেই স্থির করিল, দেখা যাক এই টাকাটা খোয়া গিয়া এই অদ্ভুত লোকটি কিরকম কাণ্ডটা করে। রাত্ৰি নটার পর ছেলে পড়াইয়া শ্ৰান্তদেহে কালীপদ ঘরের অবস্থা কিছুই লক্ষ্য করে নাই। বিশেষত মাথা তাহার যেন ছিড়িয়া পড়িতেছিল। বুঝিয়েছিল এখন কিছুদিন তাহার এই মাথার যন্ত্রণা চলিবে । পরদিন সে কাপড় বাহির করিবার জন্য তক্তাপোশের নীচে হইতে টিনের বাকিটা টানিয়া দেখিল বাক্সটা খোলা । যদিচ কালীপদ স্বভাবত অসাবধান নয়। তবু তাহার মনে হইল হয়তো সে চাবি বন্ধ করিতে ভুলিয়া গিয়াছিল। কারণ, ঘরে যদি চোর আসিত তবে বাহিরের দরজায় তালা বন্ধ থাকিত ଅଙ୍ଗ । 甲 বাক্স খুলিয়া দেখে তাহার কাপড়চোপড় সমন্ত উলটাপালট। তাহার বুক দমিয়া গেল। তাড়াতাড়ি সমস্ত জিনিসপত্র বাহির করিয়া দেখিল তাহার সেই মাতৃদত্ত নোটখানি নাই। কাগজ ও কাপড়ের মোড়কগুলা আছে। বার বার করিয়া কালীপঙ্গ সমন্ত কাপড় সবলে কাড়া দিতে লাগিল, নোট বাহির হইল না। এ দিকে উপরের তলার দুই-একটি করিয়া লোক যেন আপনি কাজে সিঁড়ি দিয়া নামিয়া সেই ঘরটার দিকে কটাক্ষপাত করিয়া বার বার উঠানামা করিতে লাগিল । উপরে অট্টহাস্যের ফোয়ারা খুলিয়া গেল । যখন নোটের কোনো আশাই রহিল না এবং মাথার কাটে যখন জিনিসপত্র নাড়ােনাড়ি করা তাহার পক্ষে আর সম্ভবপর হইল না। তখন সে বিছানার উপর উপুড় হইয়া মৃতদেহের মতো পড়িয়া রহিল । এই তাহার মাতার অনেক দুঃখের নোটখনি- জীবনের কত মুহুর্তকে কঠিন যন্মে পোষণ করিয়া দিনে দিনে একটু একটু করিয়া এই নোটখনি সঞ্চিত হইয়াছে। একদা এই দুঃখের ইতিহাস সে কিছুই জানিত না, সেদিন সে তাহার মাতার ভারের উপর ভার কেবল বাড়াইয়াছে, অবশেষে যেদিন মা তাহাকে তাহার প্রতিদিনের নিয়ত-আবর্তমান দুঃখের সঙ্গী করিয়া লইলেন সেদিনকার মতো এমন গৌরব সে তাহার বয়সে আর-কখনো ভোগ করে নাই। কালীপদ আপনার জীবনে সব চেয়ে যে বড়ো বাণী, যে মহত্তম আশীর্বাদ পাইয়াছে, এই নোটখানির মধ্যে তাহাঁই পূর্ণ হইয়া ছিল । সেই তাহার মাতার অতলম্পর্শ স্নেহসমুদ্রমন্থন-করা অমূল্য দুঃখের উপহারটুকু চুরি যাওয়াকে সে একটা পৈশাচিক অভিশাপের মতো মনে করিল। পাশের সিঁড়ির উপর দিয়া পায়ের শব্দ আজ বার বার শোনা যাইতে লাগিল । অকারণ ওঠা এবং নামার আজ আর বিরাম নাই। গ্রামে আগুন লাগিয়া পুড়িয়া ছাই হইয়া যাইতেছে আর ঠিক তাহার পাশ দিয়াই কৌতুকে কলশব্দে নদী অবিরত দুটিয়া চলিয়াছে, এও সেইরকম । উপরের তলার অট্টহাস্য শুনিয়া এক সময়ে কালীপদার হঠাৎ মনে হইল এ চোরের কাজ নয় ; এক মুহুর্তে সে বুঝিতে পারিল শৈলেন্দ্রের দল কৌতুক করিয়া তাহার এই নোট লইয়া গিয়াছে। চোরে চুরি করিলেও তাহার মনে এত বাজিত না । তাহার মনে হইতে লাগিল যেন ধানমদগর্কিত যুবকেরা তাহার মায়ের গায়ে হাত তুলিয়াছে। এতদিন কালীপদ এই মেসে আছে, এই সিঁড়িটুকু বাহিয়া একদিনও সে উপরের তলায় পদার্পণও করে নাই । আজ তাহার গায়ে সেই ছেড়া গেঞ্জি, পায়ে জুতা নাই, মনের আবেগে এবং মাথাধরার উত্তেজনায় তাহার মুখ লাল হইয়া উঠিয়াছে— সবেগে সে উপরে উঠিয়া পডিল । ክ আজ রবিবার- কলেজে যাইবার উপসর্গ ছিল না, কাঠের ছাদওয়ালা বারান্দায় বন্ধুগণ কোহ-বা চৌকিতে, কেহ-বা বেতের মোড়ায় বসিয়া হাস্যালাপ করিতেছিল । কালীপদ তাহদের মাঝখানে ছুটিয়া পড়িয়া ক্রোধগদগদম্বরে বলিয়া উঠিল, “দিন, আমার নোট দিন ।” যদি সে মিনতির সুরে বলিত। তবে ফল পাইত সন্দেহ নাই। কিন্তু উন্মত্তবৎ ক্রুদ্ধমূর্তি দেখিয়া শৈলেন অত্যন্ত ক্ষাপা হইয়া উঠিল । যদি তাহার বাড়ির দারোয়ান থাকিত তবে তাহাকে দিয়া এই অসভ্যকে কান ধরিয়া দূর করিয়া দিত সন্দেহ নাই। সকলেই দাড়াইয়া উঠিয়া একত্রে গর্জন করিয়া উঠিল, “কী বলেন মশায় । কিসের নোট ।”