পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৩৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রবীন্দ্র-রচনাবলী د S ?6 প্রথমটা রসিক মনে করে, সে তাহার দাদার বিছানার কাছে শুইয়া আছে ; মুহুর্তকাল পরেই চমক ভাঙিয়া দেখে, দাদা কাছে নাই। বাড়িতে থাকিতে এক-একদিন শীতের রাত্রে ঘুমের ঘোরে সে অনুভব করিত, দাদা তাহার শীত করিতেছে মনে করিয়া তাহার গাত্রবন্মের উপরে নিজের কাপড়খানা ধীরে ধীরে চাপাইয়া দিতেছে ; এখানে পৌষের রাত্রে যখন ঘুমের ঘোরে তাহার শীত শীত করে তখন দাদা তাহার গায়ে ঢাকা দিতে আসিবে মনে করিয়া সে যেন অপেক্ষা করিতে থাকে- দেরি হইতেছে দেখিয়া রাগ হয়। এমন সময় জাগিয়া উঠিয়া মনে পড়ে, দাদা কাছে নাই এবং সেইসঙ্গে ইহাও মনে হয় যে, এই শীতের সময় তাহার গায়ে আপন কাপড়টি টানিয়া দিতে না পারিয়া আজ রাত্রে শূন্যশয্যার প্রান্তে তাহার দাদার মনে শান্তি নাই। তখনই সেই অর্ধরাত্রে সে মনে করে, কাল সকালে উঠিয়াই আমি ঘরে ফিরিয়া যাইব । কিন্তু ভালো করিয়া জাগিয়া উঠিয়া আবার সে শক্তি করিয়া প্ৰতিজ্ঞা করে ; মনে মনে আপনাকে বার বার করিয়া জপাইতে থাকে যে, “আমি পণের টাকা ভরতি করিয়া বাইসিকলে চড়িয়া বাড়ি ফিরিব তবে আমি পুরুষমানুষ, তবে আমার নাম রসিক । একদিন দলের কর্তা তাহাকে তাতি বলিয়া বিশ্ৰী করিয়া গালি দিল । সেইদিন রসিক তাহার সামান্য কয়েকটি কাপড়, ঘটি ও থালাবাটি, নিজের যে-কিছু ঋণ ছিল তাহার পরিবর্তে ফেলিয়া রাখিয়া সম্পূর্ণ রিক্তহন্তে বাহির হইয়া চলিয়া গেল । সমান্তদিন কিছু খাওয়া হয় নাই। সন্ধ্যার সময় যখন নদীর ধারে দেখিল গোরুগুলা আরামে চরিয়া থাইতেছে তখন একপ্রকার ঈর্ষার সহিত তাহার মনে হইতে লাগিল, পৃথিবী যথার্থ এই পশুপক্ষীদের মা- নিজের হাতে তাহদের মুখে আহারের গ্রাস তুলিয়া দেন- আর মানুষ বুঝি তার কোন সতিনের ছেলে, তাই চারি দিকে এতবড়ো মােঠ ধূ ধূ করিতেছে, কোথাও রসিকের জন্য একমুষ্টি অন্ন নাই। নদীর কিনারায় গিয়া রসিক অঞ্জলি ভরিয়া খুব খানিকটা জল খাইল । এই নদীটির ক্ষুধা নাই, তৃষ্ণা নাই, কোনো অভাব নাই, কোনো চেষ্টা নাই, ঘর নাই। তবু ঘরের অভাব নাই, সম্মুখে অন্ধকার রাত্রি আসিতেছে। তবু সে নিরুদবেগে নিরুদ্দেশের অভিমুখে চুটিয়া চলিয়াছে- এই কথা ভাবিতে ভাবিতে রসিক একদৃষ্টে জলের স্রোতের দিকে চাহিয়া বসিয়া রহিলবোধ করি তাহার মনে হইতেছিল, দুর্বাহ মানবজন্মটাকে এই বন্ধনহীন নিশ্চিন্তু জলধারার সঙ্গে মিশাইয়া ফেলিতে পারিলেই একমাত্র শান্তি । এমন সময় একজন তরুণ যুবক মাথা হইতে একটা বস্তা নামাইয়া তাহার পাশে বসিয়া কোচার প্রান্ত হইতে চিড়া খুলিয়া লইয়া ভিজাইয়া খাইবার উদ্যোগ করিল। এই লোকটিকে দেখিয়া রসিকের কিছু নূতন রকমের ঠেকিল। পায়ে জুতা নাই, ধুতির উপর একটা জামা, মাথায় পাগড়ি পরাদেখিবামাত্র স্পষ্ট মনে হয়, ভদ্রলোকের ছেলে- কিন্তু মুটেমজুরের মতো কেন যে সে এমন করিয়া বস্তা বহিয়া বেড়াইতেছে। ইহা সে বুঝিতে পারিল না । দুইজনের আলাপ হইতে দেরি হইল না এবং রসিক ভিজা চিড়ার যথোচিত পরিমাণে ভাগ লইল । এ ছেলেটি কলিকাতার কলেজের ছাত্র । ছাত্রেরা যে স্বদেশী কাপড়ের দোকান খুলিয়াছে তাহারই জন্য দেশি কাপড় সংগ্ৰহ করিতে সে এই গ্রামের হাটে আসিয়াছে। নাম সুবোধ, জাতিতে ব্ৰাহ্মণ । তাহার কোনো সংকোচ নাই, বাধা নাই- সমস্তদিন হাটে, ঘুরিয়া সন্ধ্যাবেলায় চিড়া ভিজাইয়া খাইতেছে। দেখিয়া নিজের সম্বন্ধে রসিকের ভারি একটা লজা বোধ হইল। শুধু তাই নয়, তাহার মনে হইল, যেন মুক্তি পাইলাম। এমন করিয়া খালি পায়ে মজুরের মতো যে মাথায় মোট বহিতে পারা যায়। ইহা উপলব্ধি করিয়া জীবনযাত্রার ক্ষেত্র এক মুহুর্তে তাহার সম্মুখে প্রসারিত হইয়া গেল। সে ভাবিতে লাগিল, আজ তো আমার উপবাস করিবার কোনো দরকারই ছিল না- আমি তো ইচ্ছা করিলেই মোট বহিতে পারিতাম । সুবোধ যখন মোট মাথায় লইতে গেল রসিক বাধা দিয়া বলিল, “মোট আমি বহিব।” সুবোধ কলিকাতায় লইয়া যান।” “আমি উঠতি আগে হইলে রসিক এ কথা কখনোই মুখে উচ্চারণ করিতে পারিত না- তাহার বাধা কাটিয়া গেছে ।