পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৩৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

6 Sbr রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী কাপুরুষতার সব চেয়ে চূড়ান্ত পরিচয় বলিয়া মনে হইল। না— এতবড়ো দীনতা স্বীকার করিয়া গ্রামে ফিরিয়া যাওয়া কোনােমতেই হইতে পারে না। \ অনাবৃষ্টি যখন চলিতে থাকে তখন দিনের পর দিন কাটিয়া যায় মেঘের আর দেখা নাই, যদি-বা মেঘ দেখা দেয় বৃষ্টি পড়ে না, যদি-বা বৃষ্টি পড়ে তাহাতে মাটি ভেজে না ; কিন্তু বৃষ্টি যখন নামে তখন । দিগম্ভের এক কোণে যেমনি মেঘ দেখা দেয় অমনি দেখিতে দেখিতে আকাশ ছাইয়া ফেলে এবং অবিরল বর্ষণে পৃথিবী ভাসিয়া যাইতে থাকে। রসিকের ভাগ্যে হঠাৎ সেইরকমটা ঘটিল । জানকী নন্দী মস্ত ধনী লোক । সে একদিন কাহার কাছ হইতে কী একটা খবর পাইল ; তাতের ইস্কুলের সামনে তাহার জুড়ি আসিয়া থামিল, তাতের ইস্কুলের মাস্টারের সঙ্গে তাহার দুই-চারটে কথা হইল এবং তাহার পরদিনেই রসিক আপনার মেসের বাসা পরিত্যাগ করিয়া নদীবাবুদের মন্ত তেতালা বাড়ির এক ঘরে আশ্রয় গ্ৰহণ করিল। নদীবাবুদের বিলাতের সঙ্গে কমিশন এজেন্সির মন্ত কারবার- সেই কারবারে কেন যে জানকীবাবু অযাচিতভাবে রসিককে একটা নিতান্ত সামান্য কাজে নিযুক্ত করিয়া যথেষ্ট পরিমাণে বেতন দিতে লাগিলেন তাহা রসিক বুঝিতেই পারিল না । সেরকম কাজের জন্য লোক সন্ধান করিবার দরকারই হয় না, এবং যদি-বা লোক জোটে তাহার তো এত আদর নহে । বাজারে নিজের মূল্য কত এতদিনে রসিক তাহা বুঝিয়া লইয়াছে, অতএব জানকীবাবু যখন তাহাকে ঘরে রাখিয়া যত্ন করিয়া খাওয়াইতে লাগিলেন তখন রসিক তাহার এত আদরের মূল কারণ সুদূর আকাশের গ্রহনক্ষত্র ছাড়া আর-কোথাও খুঁজিয়া *झेळ् व् । কিন্তু তাহার শুভগ্রহটি অত্যন্ত দূরে ছিল না । তাহার একটু সংক্ষিপ্ত বিবরণ বলা আবশ্যক । একদিন জানকীবাবুর অবস্থা এমন ছিল না । তিনি যখন কষ্ট করিয়া কলেজে পড়িতেন তখন তাহার সতীর্থ হরমোহন বসু ছিলেন তাহার পরম বন্ধু । হরমোহন ব্ৰাহ্মসমাজের লোক । এই কমিশন এজেন্সি হরমোহনদেরই পৈতৃক বাণিজ্য- তাহাদের একজন মুরুব্বি ইংরেজ সদাগর তাহার পিতাকে অত্যন্ত ভালোবাসিতেন । তিনি তাহাকে এই কাজে জুডিয়া দিয়াছিলেন । হরমোহন তাহার নিঃস্ব বন্ধু জানকীকে এই কাজে টানিয়া লইয়াছিলেন । সেই দরিদ্র অবস্থায় নূতন যৌবনে সমাজসংস্কার সম্বন্ধে জানকীর উৎসাহ হরমোহনের চেয়ে কিছুমাত্র কম ছিল না । তাই তিনি পিতার মৃত্যুর পরে তাহার ভগিনীর বিবাহের সম্বন্ধ ভাঙিয়া দিয়া তাহাকে বড়ো বয়স পর্যন্ত লেখাপড়া শিখাইতে প্ৰবৃত্ত হইলেন । ইহাতে তাহদের তন্তুবায়সমাজে যখন তাহার ভগিনীর বিবাহ অসম্ভব হইয়া উঠিল তখন কায়স্থ হরমোহন নিজে তাহাকে এই সংকট হইতে উদ্ধার করিয়া এই মেয়েটিকে বিবাহ করিলেন । 嘻 তাহার পরে অনেকদিন চলিয়া গিয়াছে । হরমোহনেরও মৃত্যু হইয়াছে- তাহার ভগিনীও মারা গেছে। ব্যাবসাটিও প্রায় সম্পূর্ণ জানকীর হাতে আসিয়াছে। ক্রমে বাসাবাড়ি হইতে তাহার তেতালা । বাড়ি হইল, চিরকালের নিকেলের ঘড়িটিকে অপমান করিয়া তাড়াইয়া দিয়া সোনার ঘড়ি সুয়োরানীর মতো তাহার বক্ষের পার্থে টিকটিক করিতে লাগিল । এইরূপে তাহার তহবিল যতই সহঁকীত হইয়া উঠিল, অল্পবয়সের অকিঞ্চন অবস্থার সমস্ত উৎসাহ ততই তাহার কাছে নিতান্ত ছেলেমানুষি বলিয়া বোধ হইতে লাগিল । কোনোমতে পারিবারিক পূর্ব-ইতিহাসের এই অধ্যায়টাকে বিলুপ্ত করিয়া দিয়া সমাজে উঠিবার জন্য তাহার রেখ চাপিয়া উঠিল । নিজের মেয়েটিকে সমাজে বিবাহ দিবেন। এই তাহার জেদ । টাকার লোভ দেখাইয়া দুই-একটি পাত্রকে রাজি করিয়াছিলেন, কিন্তু যখনই তাহদের আত্মীয়েয়া খবর পাইল তখনই তাহারা গোলমাল করিয়া বিবাহ ভাঙিয়া দিল । শিক্ষিত সৎপাত্র না হইলেও তাহার চলে- কন্যার চিরজীবনের সুখ বলিদান দিয়াও তিনি সমাজদেবতার প্রসাদ লাভের জন্য উৎসুক হইয়া উঠিলেন ।