পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৪৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

○ ●> মাত্র, তার ফোন কোনো অবলম্বন নেই। সাধারণত সংসারে আমরা কতকগুলি বিশেষ ঘটনা আশ্রয় করে সুখে দুঃখে বিচলিত হই। সেই ঘটনা সত্যও হতে পারে, কাল্পনিকও হতে পারে অর্থাৎ আমাদের কাছে সত্যের মতো প্ৰতিভাত হতে পারে। তারই আঘাতে আমাদের চেতনা নানারকমে নাড়া পায়, সেই নাড়ার প্রকারভেদে আমাদের আবেগের প্রকৃতিভেদ ঘটে। কিন্তু গানের সুরে আমাদের চেতনাকে যে নাড়া দেয় সে কোনো ঘটনার উপলক্ষ্য দিয়ে নয়, সে একেবারে অব্যবহিত ভাবে । সুতরাং তাতে যে আবেগ উৎপন্ন হয় সে অহৈতুক আবেগ । তাতে আমাদের চিত্ত নিজের স্পন্দনবেগেই নিজেকে জানে, বাইরের সঙ্গে কোনো ব্যবহারের যোগে নয় । সংসারে আমাদের জীবনে যে-সব ঘটনা ঘটে তার সঙ্গে নানা দায় জড়ানো আছে। জৈবিক দায়, বৈষয়িক দায়, সামাজিক দায়, নৈতিক দায় । তার জন্যে নানা চিন্তায় নানা কাজে আমাদের চিত্তকে বাইরে বিক্ষিপ্ত করতে হয় । শিল্পকলায়, কাব্যে এবং রসসাহিত্যমাত্রেই আমাদের চিত্তকে সেই সমস্ত দায় থেকে মুক্তি দেয়। তখন আমাদের চিত্ত সুখদুঃখের মধ্যে আপনারই বিশুদ্ধ প্রকাশ দেখতে পায় । সেই প্রকাশই আনন্দ । এই প্ৰকাশকে আমরা চিরন্তন বলি এইজন্যে যে, বাইরের ঘটনাগুলি সংসারের জাল বুনতে বুনতে, নানা প্রয়োজন সাধন করতে করতে, সরে যায়, চলে যায়- তাদের নিজের মধ্যে নিজের কোনো চরম মূল্য নেই। কিন্তু আমাদের চিত্তের যে আত্মপ্রকাশ তার আপনাতেই আপনার চরম, তার মূল্য তার আপনার মধ্যেই পর্যাপ্ত। তমসা তীরে ক্ৰৌঞ্চবিরাহিণীর দুঃখ কোনোখানেই নেই, কিন্তু আমাদের চিত্তের আত্মানুভূতির মধ্যে সেই বেদনার তার বাধা হয়েই আছে। সে ঘটনা এখন * ঘটছে না, বা সে ঘটনা কোনোকালেই ঘটে নি, এ কথা তার কাছে প্ৰমাণ করে কোনো লাভ নেই। যা হোক, দেখা যাচ্ছে গানের স্পন্দন আমাদের চিত্তের মধ্যে যে আবেগ জমিয়ে দেয় সে কোনো সাংসারিক ঘটনামূলক আবেগ নয় । তাই মনে হয়, সৃষ্টির গভীরতার মধ্যে যে একটি বিশ্বব্যাপী প্ৰাণকম্পন চলছে, গান শুনে সেইটেরই বেদনাবেগ যেন আমরা চিত্তের মধ্যে অনুভব করি । ভৈরবী যেন সমন্ত সৃষ্টির অন্তরতম বিরহব্যাকুলতা, দেশমল্লার যেন অশ্রাগঙ্গোত্রীর কোন আদিনিবারের কলকল্লোল । এতে করে আমাদের চেতনা দেশকালের সীমা পার হয়ে নিজের চঞ্চল প্ৰাণধারাকে বিরাটের মধ্যে উপলব্ধি করে । কাব্যেও আমরা আমাদের চিত্তের এই আত্মানুভূতিকে বিশুদ্ধ এবং মুক্তভাবে অথচ বিচিত্র আকারে পেতে চাই। কিন্তু কাব্যের প্রধান উপকরণ হল কথা। সে তো সুরের মতো স্বপ্রকাশ নয়। কথা অর্থকে জানাচ্ছে । অতএব কাব্যে এই অর্থকে নিয়ে কারবার করতেই হবে । তাই গোড়ায় দরকার, এই অর্থটা যেন রাসমূলক হয়। অর্থাৎ সেটা এমন কিছু হয় যা স্বতই আমাদের মনে স্পন্দন সঞ্চার করে, যাকে আমরা বলি আবেগ । কিন্তু যেহেতু কথা জিনিসটা স্বপ্রকাশ নয়, এইজন্যে সুরের মতো কথার সঙ্গে আমাদের চিত্তের সাধৰ্মা নেই। আমাদের চিত্ত বেগবান, কিন্তু কথা স্থির । এ প্রবন্ধের আরতেই আমরা এই বিষয়টার আলোচনা করেছি। বলেছি, কথাকে বেগ দিয়ে আমাদের চিত্তের সামগ্ৰী করে তোলবার জন্যে ছন্দের দরকার । এই ছন্দের বাহনযোগে কথা কেবল যে দ্রুত আমাদের চিত্তে প্ৰবেশ করে তা নয়, তার স্পন্দনে নিজের সম্পন্দন যোগ করে দেয় । এই স্পন্দনের যোগে শব্দের অর্থ যে কী অপরাপ্যতা লাভ করে তা আগে থাকতে হিসাব করে বলা যায় না । সেইজন্যে কাব্যরচনা একটা বিস্ময়ের ব্যাপার । তার বিষয়টা কবির মনে বাধা, কিন্তু কাব্যের লক্ষ্য হচ্ছে বিষয়কে অতিক্রম করা ; সেই বিষয়ের চেয়ে বেশিটুকুই হচ্ছে অনির্বচনীয়। ছন্দের গতি কথার মধ্য থেকে সেই অনির্বাচনীয়কে জাগিয়ে তোলে । রজনী শাঙনঘন, ঘন দেয়া-গরজন, রিমিকিমি শবদে বরিযে । পালন্তে শয়ন রঙ্গে, বিগলিত টীয় অঙ্গে, নিন্দ যাই মনের হরিবে ।