পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৬৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Q8 と রবীন্দ্র-রচনাবলী NR দিলীপকুমার আশ্বিনের উত্তরায় ছন্দ সম্বন্ধে আমার দুই-একটি চিঠির খণ্ড ছাপিয়েছেন। সর্বশেষে যে নোটটুকু দিয়েছেন তার থেকে বোঝা গেল, আমি যে কথা বলতে চেয়েছি। এখনো সেটা তার কাছে স্পষ্ট হয় নি । তিনি আমারই লেখার নজির তুলে দেখিয়েছেন যে, নিম্নলিখিত কবিতায় আমি 'একেকটি শব্দটাকে চার মাত্রার ওজন দিয়েছি । ইচ্ছা করে অবিরত Tesels: AGINT গল্প লিখি একেকটি করে । এ দিকে নীরেনবাবুর রচনায় “একটি কথা এতবার হয় কলুষিত” পদটিতে 'একটি' শব্দটাকে দুই মাত্রায় গণ্য করতে আপত্তি করি নি বলে তিনি দ্বিধা বোধ করছেন । তর্ক না করে দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক । একটি কথার লাগি তিনটি রজনী জাগি, একটুও নাহি মেলে সাড়া । সখীরা যখন জোটে মুখে তব বন্যা ছোটে, গোলমালে তোলপাড় পাড়া । * একটি ‘তিনটি একটু শব্দগুলি হসন্তমধ্য, ‘গোলমাল” “তোলপাড়াও সেই জাতের । অথচ হসন্তে ধ্বনিলাঘবতার অভিযোগে ওদের মাত্র জরিমানা দিতে হয় নি । তিন মাত্রা ও চার মাত্রার গৌরবেই রয়ে গেল ; কেউ কেউ বলেন, কেবলমাত্র অক্ষরগণনার দোহাই দিয়েই এরা মান বাচিয়েছে, অর্থাৎ যদি যুক্ত অক্ষরেব ছাদে লেখা যেত তা হলেই ছন্দে ধ্বনির কমতি ধরা পড়ত । আমার বক্তব্য এই যে, চোখ দিয়ে ছন্দ পড়া আর বাইসিকল-এর চাকা দিয়ে হামাগুড়ি দেওয়া একই কথা, ওটা হবার জো নেই ; বিরুদ্ধ দৃষ্টান্ত দিলে কথাটা বোঝা যাবে । টােটকা এই মুষ্টিযোগ লটকানের ছাল, সিটিকে মুখ খাবি, জ্বর আটকে যাবে কাল । বলে রাখা ভালো এটা ভিষক-ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন নয়, সাহিত্য-ডাক্তারের বানানো ছড়া, ছন্দ সম্বন্ধে মতসংশয় নিবারণের উদ্দেশ্যে ; এর থেকে অন্য কোনো রোগের প্রতিকার কেউ যেন আগা না করেন । আরো একটা একটি কথা শুনিবারে তিনটে রাত্রি মাটি, এর পরে ঝগড়া হবে, শেষে দাঁতকপাটি । তথবী একটি কথা শোনো, মনে খটকা নাহি রেখে, টাটকা মাছ জুটুল না তো, শুটকি দেখো চোখে । শেষের তিনটি ছড়ায় অক্ষর গুনতি করতে গেলে দৃশ্যত পয়ারের সীমা ছাড়িয়ে যায়, কিন্তু তাই বলেই যে পয়ার ছন্দের নির্দিষ্ট ধ্বনি বেড়ে গেল তা নয় । আপাতত মনে হয়, এটা যথেচ্ছাচার । কিন্তু হিসাব করে দেখলেই দেখা যাবে ছন্দের নীতি নষ্ট করা হয় নি। কেননা, তার জো নেই। এ তো রাজত্ব করা নয় কবিত্ব করা, এখানে লক্ষ্য হল মনোরঞ্জন ; থামক একটা জবরদস্তির আইন জারি করে তার পরে পাহারাওয়ালা লাগিয়ে দেওয়া, ব্যাপারটা এত সহজ নয় । ধবনির রাজ্যে গোয়ার্তমি করে কেউ জিতে যাবে এমন সাধ্য আছে কার । চব্বিশ ঘণ্টা কান রয়েছে সতর্ক । আমি এই কথাটি বােঝাতে চেষ্টা করছি যে, আক্ষরিক ছন্দ বলে কোনাে অদ্ভুত পদাৰ্থ বাংলায় কিংবা অন্য কোনো ভাষাতেই নেই। অক্ষর ধ্বনির চিহ্নমাত্র । যেমন 'জল' শব্দটাকে দিয়ে জল পদার্থটার প্রতিবাদ চলে না, অক্ষরকে ধ্বনির প্রতিপক্ষ দাড় করানো তেমনি বিড়ম্বনা ।