পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬০০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ছন্দ (ጵbr© যখন না আছে ওর বন্ধু না আছে দোসর । আমি বেশ জানি, আমি তো পারতুম না । গুটিকতক পাতাওয়ালা একটি ডাল তার ভেঙে নিলেম, তাতে জড়িয়ে দিলেম। শ্যাওলা । নিয়ে এসে চোখের সামনে রেখে দিলেম আমার ঘরে ; প্রিয় বন্ধুদের কথা স্মরণ করাবার জন্যে যে তা নয় । (সম্প্রতি ওই বন্ধুদের ছাড়া আর কোনো কথা আমার মনে ছিল না ।) ও রইল, একটি অদ্ভুত চিহ্নের মতো, পুরুষের ভালোবাসা যে কী তাই মনে করাবে। তা যাই হােক, যদিও সেই তাজা ওক গাছ লুইসিয়ানার বিতীর্ণ মাঠে একলা কলমল করছে, বিনা বন্ধু বিনা দোসরে খুশিতে ভরা পাতাগুলি প্রকাশ করছে। চিরজীবন ধরে, তবু আমার মনে হয়, আমি তো পারতুম না । এক দিকে দাড়িয়ে আছে কঠিন বলিষ্ঠ সতেজ ওক গাছ, একলা আপন আত্মসম্পূর্ণ নিঃসঙ্গতায় আনন্দময় ; আর-এক দিকে একজন মানুষ, সেও কঠিন বলিষ্ঠ সতেজ, কিন্তু তার আনন্দ অপেক্ষা করছে প্রিয়সঙ্গের জন্যে- এটি কেবলমাত্র সংবাদরূপে গদ্যে বলবার বিষয় নয় । এর মধ্যে কবির আপন মনোভাবের একটি ইশারা আছে। একলা গাছের সঙ্গে তুলনায় একলা বিরহী-হৃদয়ের উৎকণ্ঠা আভাসে জানানো হল । এই প্রচ্ছন্ন আবেগের ব্যাজনা, এই তো কাব্য ; এর মধ্যে ভাববিন্যাসের শিল্প আছে, তাকেই বলব ভাবের ছন্দ । চীন-কবিতার তরজমা থেকে একটি দৃষ্টান্ত দেখাই । স্বপ্ন দেখলেম, যেন চড়েছি কোনো উচু ডাঙায় ; সেখানে চোখে পড়ল গভীর এক ইদারা । চলতে চলতে কণ্ঠ আমার শুকিয়েছে ; ইচ্ছে হল, জল খাই । ব্যগ্ৰ দৃষ্টি নামতে চায় ঠাণ্ডা। সেই কুয়োর তলার দিকে । ঘুরলেম চার দিকে, দেখলেম ভিতরে তাকিয়ে, জলে পড়ল আমার ছায়া । দেখি এক মাটির ঘাড়া কালো সেই গহবরে ; দড়ি নাই যে তাকে টেনে তুলি । ঘড়াটা পাছৈ তলিয়ে যায় এই ভেবে প্ৰাণ কেন এমন ব্যাকুল হল । পাগলের মতো ছুটলেম সহায় খুঁজতে । গ্রামে গ্রামে ঘুরি, লোক নেই। একজনও, কুকুরগুলো ছুটে আসে। টুটি কামড়ে ধরতে । কঁদতে কঁাদতে ফিরে এলেম কুয়োর ধারে । জল পড়ে দুই চোখ বেয়ে, দৃষ্টি হল অন্ধপ্রায় । শেষকালে জাগালেম নিজেরই কাল্লার শব্দে । ঘর নিন্তব্ধ, তন্ধ সব বাড়ির লোক ;