পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬১৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Gabr রবীন্দ্র-রচনাবলী একান্নাবতী পরিবারের মতো । বাড়ির কর্তটিকেই স্পষ্ট করিয়া অনুভব করা যায়। কিন্তু তাহায় পশ্চাতে তাহার কত পোষ্য আছে, তাহারা আছে কি নাই, তাহার হিসাব রাখিবার দরকার হয় না । * এইজন্য দেখা যায়, আমাদের দেশে কথকতা যদিচ জনসাধারণকে শিক্ষা এবং আমোদ দিবার জন্য, তথাপি কথকমহাশয় ক্ষণে ক্ষণে তাহার মধ্যে ঘনঘটাচ্ছন্ন সংস্কৃত সমাসের আমদানি করিয়া থাকেন। সে-সকল শব্দ গ্রাম্যলোকেরা বােঝে না, কিন্তু এই সমস্ত গভীর শব্দের আওয়াজে তাহাদের মনটা ভালো করিয়া জাগিয়া ওঠে । বাংলাভাষায় শব্দের মধ্যে আওয়াজ মৃদু বলিয়া অনেক সময় আমাদের কবিদিগকে দায়ে পড়িয়া অপ্রচলিত সংস্কৃত শব্দ ব্যবহার করিতে হয় । এইজন্যই আমাদের যাত্রার ও পাচলির গানে ঘন ঘন অনুপ্রাস ব্যবহারের প্রথা আছে। সে অনুপ্রাস অনেক সময় অর্থহীন এবং ব্যাকরণবিরুদ্ধ ; কিন্তু সাধারণ শ্রোতাদের পক্ষে তাহার প্রয়োজন এত অধিক যে বাছ-বিচার করিবার সময় পাওয়া যায় না। নিরামিষ তরকারি রাধিত হইলে কাল-মসলা বেশি করিয়া দিতে হয়, নহিলে স্বাদ পাওয়া যায় না । এই মসলা পুষ্টির জন্য নহে ; ইহা কেবলমাত্র রসনাকে তাড়া দিয়া উত্তেজিত করিবার জন্য । সেইজন্য দাশরথি রায়ের রামচন্দ্র যখন নিম্নলিখিত রীতিতে অনুপ্রাসচ্ছটা বিস্তার করিয়া বিলাপ করিতে থাকেন— অতি অগণ্য কাজে ছিছি। জঘন্য সাজে ঘোর অরণ্যমাঝে কত কাদিলামতাহাতে শ্রোতার হৃদয় ক্ষুব্ধ হইয়া উঠে । আমাদের বন্ধু দীনেশবাবু-কর্তৃক পরমপ্রশংসিত কৃষ্ণকমল গোস্বামী মহাশয়ের গানের মধ্যে নিম্নলিখিত প্রকারের আবর্জনা বুড়িকুড়ি চাপিয়া আছে । তাহাতে काशक९3 दार्थी gाग्न ना । পুনঃ যদি কোনক্ষণে দেখা দেয় কমলেক্ষণে যতনে করে রক্ষণে জানাবি তৎক্ষণে । এখানে কমলেক্ষণ এবং রক্ষণ শব্দটাতে এ-কার যোগ করা একেবারেই নিরর্থক ; কিন্তু অনুপ্রাসের বন্যার মুখে অমন কত এ-কার উ-কার স্থানে অস্থানে ভাসিয়া বেড়ায় তাহাতে কাহারও কিছু আসে যায় माँ ! একটা কথা মনে রাখিতে হইবে, বাংলা রামায়ণ, মহাভারত, অন্নদামঙ্গল, কবিকঙ্কণচণ্ডী প্রভৃতি সমস্ত পুরাতন কাব্য গানের সুরে কীর্তিত হইত। এইজন্য শব্দের মধ্যে যাহা কিছু ক্ষীণতা ও ছন্দের মধ্যে যাহা কিছু ফাক ছিল সমস্তই গানের সুরে ভরিয়া উঠিত ; সঙ্গে সঙ্গে চামর দুলিত, করতাল চলিত এবং মৃদঙ্গ বাজিতে থাকিত । সেই-সমস্ত বাদ দিয়া যখন আমাদের সাধুসাহিত্য-প্রচলিত ছন্দগুলি পড়িয়া দেখি, তখন দেখিতে পাই একে তো প্ৰত্যেক কথাটিতে স্বতন্ত্র ঝোক নাই, তাহাতে প্ৰত্যেক অক্ষরটি একমাত্রা বলিয়া গণ্য হইয়াছে।-- t গানের পক্ষে ইহাই সুবিধা । বাংলার সমতল ক্ষেত্রে নদীর ধারা যেমন স্বচ্ছন্দে চারি দিকে শাখায় প্ৰশাখায় প্রসারিত হইয়াছে, তেমনি সমমাত্রিক ছন্দে সুর আপনি প্রয়োজনমত যেমন-তেমন করিয়া চলিতে পারে। কথাগুলা মাথা হেঁট করিয়া সম্পূৰ্ণ তাহার অনুগত হইয়া থাকে । কিন্তু, সুর হইতে বিযুক্ত করিয়া পড়িতে গেলে এই ছন্দগুলি একেবারে বিধবার মতো হইয়া পড়ে। এইজন্য আজ পর্যন্ত বাংলা কবিতা পড়িতে হইলে আমরা সুর করিয়া পড়ি । এমন-কি, আমাদের গদ্য আবৃত্তিতেও যথেষ্ট পরিমাণে সুর লাগে। আমাদের ভাষার প্রকৃতি-অনুসারেই এরূপ ঘটিয়াছে। আমাদের এই অভ্যাসবশত ইংরেজি পড়িবার সময়েও আমরা সুর লাগাই ; ইংরেজের কানে নিশ্চয়ই ठाश अङ्गूठ लागि । কিন্তু, আমাদের প্রত্যেক অক্ষরটিই যে বস্তুত এক মাত্রার এ কথা সত্য নহে। যুক্ত বৰ্ণ এবং অযুক্ত বৰ্ণ কখনোই এক মাত্রার হইতে পারে না । কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান।