পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৩৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VN) N রবীন্দ্র-রচনাবলী কায়দা চাই । চারি দিক বেষ্টন করে আলোটা মালাটা দিয়ে তার চালচিত্র খাড়া না করলে মানানসই হয় না। কিন্তু, এমন মেয়ে দেখা যায় যার সহজ চলনের মধ্যেই বিনা ছন্দের ছন্দ আছে । কবিরা সেই অনায়াসের চলন দেখেই নানা উপমা খুঁজে বেড়ায় । সে মেয়ের চলনটাই কাব্য, তাতে নাচের তাল নাই-বা লাগল ; তার সঙ্গে মৃদঙ্গর বোল দিতে গেলে বিপত্তি ঘটবে। তখন মৃদঙ্গকে দোষ দেব না। তার চলনকে ? সেই চলন নদীর ঘাট থেকে আরম্ভ করে রান্নাঘর বাসরঘর পর্যন্ত । তার জন্যে মালমসলা বাছাই করে বিশেষ ঠাট বানাতে হয় না । গদ্যকাব্যেরও এই দশা । সে নাচে না, সে চলে । সে সহজে চলে বলেই তার গতি সর্বত্র । সেই গতিভঙ্গি আবাধা । ভিড়ের ছোওয়া বাচিয়ে পোশাকি-শাড়ির-প্রান্ত-তুলে-ধরা আধাঘোমটা-টানা সাবধান চাল তার নয় । এই গেল আমার "পুনশ্চ’ কাব্যগ্রন্থের কৈফিয়ত । আরো-একটা পুনশ্চ-নাচের আসরে নাট্যাচার্য হয়ে বসব না, এমন পণ করি নি। কেবলমাত্র কাব্যের অধিকারকে বাড়াব মনে করেই একটা দিকের বেড়ায় গোট বসিয়েছি । এবারকার মতো আমার কাজ ঐ পর্যন্ত । সময় তো বেশি নেই। এর পরে আবার কোন খেয়াল আসবে বলতে পারি নে। যারা দৈবদুৰ্যোগে মনে করবেন, গদ্যে কাব্যরচনা সহজ, তারা এই খোলা দরজাটার কাছে ভিড় করবেন সন্দেহ নেই । তা নিয়ে ফৌজদারি বাধলে আমাকে স্বাদলের লোক বলে স্বপক্ষে সাক্ষী মেনে বসবেন । সেই দুদিনের পূর্বেই নিরুদ্দেশ হওয়া ভালো । এর পরে মদ্রচিত আরো একখানা কাব্যগ্রন্থ বেরবে, তার নাম "বিচিত্রিতা' । সেটা দেখে ভদ্রলোকে এই মনে করে আশ্বস্ত হবে যে, আমি পুনশ্চ প্রকৃতিস্থ হয়েছি।-- দেওয়ালি ১৩৩৯ 8 সম্প্রতি কতকগুলো গদ্যকবিতা জড়ো করে ‘শেষসপ্তক' নাম দিয়ে একখানি বই বের করেছি । সমালোচকরা ভেবে পাচ্ছেন না ঠিক কী বলবেন । একটা কিছু সংজ্ঞা দিতে হবে, তাই বলছেন আত্মজৈবনিক । অসম্ভব নয়, কিন্তু তাতে বলা হল না, এগুলো কবিতা কিংবা কবিতা নয় কিংবা কোন দরের কবিতা । এদের সম্বন্ধে মুখ্য কথা যদি এই হয় যে, এতে কবির আত্মজীবনের পরিচয় আছে, তা হলে পাঠক অসহিষ্ণু হয়ে বলতে পারে, আমার তাতে কী । মদের গেলাসে যদি রঙকরা জল রাখা যায় তা হলে মদের হিসাবেই ওর বিচার আপনি উঠে পড়ে । কিন্তু, পাথরের বাটিতে রঙিন পানীয় দেখলে মনের মধ্যে গোড়াতেই তর্ক ওঠে, ওটা শরবত না ওষুধ । এরকম দ্বিধার মধ্যে পড়ে সমালোচক এই কথাটার পরেই জোর দেন যে, বাটিটা জয়পুরের কি মুঙ্গেরের । হায় রে, রসের যাচাই করতে যেখানে পিপাসু এসেছিল। সেখানে মিলল পাথরের বিচার । আমি কাব্যের পসারি, আমি শুধোই— লেখাগুলোর ভিতরে ভিতরে কি স্বাদ নেই, ভঙ্গি নেই, থেকে থেকে কটাক্ষ নেই, সদর দরজার চেয়ে এর খিড়কির দুয়ারের দিকেই কি ইশারা নেই, গদ্যের বকুনির মুখে রাস টেনে ধরে তার মধ্যে কি কোথাও দুলকির চাল আনা হয় নি, চিন্তাগৰ্ভ কথার মুখে কোনোখানে অচিন্ত্যের ইঙ্গিত কি লাগিল না, এর মধ্যে ছন্দোরাজকতার নিয়ন্ত্রিত শাসন না থাকলেও আত্মরাজকতার অনিয়ন্ত্রিত সংযম নেই কি । সেই সংযমের গুণে থেমে যাওয়া কিংবা হঠাৎ-বেকে-যাওয়া কথার মধ্যে কোথাও কি নীরবের সরবতা পাওয়া যাচ্ছে না। এইসকল প্রশ্নের উত্তরই হচ্ছে এর সমালোচনা। কালিদাস "রঘুবংশের গোড়াতেই বলেছেন, বাকা এবং অর্থ একত্র সমপূক্ত থাকে ; এমন স্থলে বাকা এবং অর্থাতীতকে একত্র সমপূক্ত করার দুঃসাধ্য কাজ হচ্ছে কবির, সেটা গদ্যোই হোক আর পদোই হোক তাতে কী এল গেল । 9硕a>>94