পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৩৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

هوا G অন্তরে যে ভাবটা অনির্বাচনীয় তাকে প্ৰেয়সী নারী প্ৰকাশ করবে গানে নাচে, এটাকে লিরিক বলে স্বীকার করা হয় । এর ভঙ্গিগুলিকে ছন্দের বন্ধনে বেঁধে দেওয়া হয়েছে ; তারা সেই ছন্দের শাসনে পরম্পরকে যথাযথভাবে মেনে চলে বলেই তাদের সুনিয়ন্ত্রিত সম্মিলিত গতিতে একটি শক্তির উদ্ভব হয়, সে আমাদের মনকে প্রবল বেগে আঘাত দিয়ে থাকে । এরজন্যে বিশেষ প্ৰসাধন, আয়োজন, বিশেষ রঙ্গমঞ্চের আবশ্যক ঘটে । সে আপনার একটি স্বাতন্ত্র্য সৃষ্টি করে, একটি দূরত্ব । কিন্তু, একবার সরিয়ে দাও ঐ রঙ্গমঞ্চ, জরির-আঁচলা-দেওয়া বেনারসি শাড়ি তোলা থাক পেটিকায়, নাচের বন্ধনে তনু দেহের গতিকে মধুর নিয়মে নাই-বা সংযত করলে— তা হলেই কি রস নষ্ট হল । তা হলেও দেহের সহজ ভঙ্গিতে কান্তি আপনি জাগে, বাহুর ভাষায় যে বেদনার ইঙ্গিত ঠিকরে ওঠে সে মুক্ত বলেই যে নিরর্থক এমন কথা যে বলতে পারে তার রসবােধ অসাড় হয়েছে। সে নাচে না বলেই যে তার চলনে মাধুর্যের অভাব ঘটে কিংবা সে গান করে না বলেই যে তার কানে-কানে কথার মধ্যে কোনো ব্যঞ্জনা থাকে না, এ কথা অশ্রদ্ধেয় । বরঞ্চ এই অনিয়মিত কলায় একটি বিশেষ । গুণের বিকাশ হয়, তাকে বলব ভাবের স্বচ্ছন্দতা, আপনি আন্তরিক সত্যেই তার আপনার পর্যাপ্তি । তার বাহুল্যবর্জিত আত্মনিবেদনে তার সঙ্গে আমাদের অত্যন্ত কাছের সম্বন্ধ ঘটে । অশোকের গাছে সে আলতা-আঁকা নুপুরশিঞ্জিত পদাঘাত নাই করল ; নাহয় কোমরে আঁট আঁচল বাধা, বা হাতের কুক্ষিতে বুড়ি, ডান হাত দিয়ে মাচা থেকে লাউশাক তুলছে, অযত্নশিথিল খোপা ঝুলে পড়েছে আলগা হয়ে ; সকালের রৌদ্রজড়িত ছায়াপথে হঠাৎ এই দৃশ্যে কোনো তরুণের বুকের মধ্যে যদি ধক করে ধাক্কা লাগে। তবে সেটাকে কি লিরিকের ধাক্কা বলা চলে না, নাহয় গদ্য-লিরিকই হল । এ রস শালপাতায় তৈরি গদ্যের পেয়ালাতেই মানায়, ওটাকে তো ত্যাগ করা চলবে না। প্রতিদিনের তুচ্ছতার মধ্যে একটি স্বচ্ছতা আছে, তার মধ্যে দিয়ে অতুচ্ছ পড়ে ধরা— গদ্যের আছে সেই সহজ স্বচ্ছতা । তাই বলে এ কথা মনে করা ভুল হবে যে, গদ্যকাব্য কেবলমাত্র সেই অকিঞ্চিৎকর কাব্যবস্তুর বাহন। বৃহতের ভার অনায়াসে বহন করবার শক্তি গদ্যছন্দের মধ্যে আছে ! ও যেন বনস্পতির মতো, তার পল্লবপুঞ্জের ছন্দোবিন্যাস কাটছাট সাজানো নয়, অসম তার স্তবকগুলি, তাতেই তার গাম্ভীর্য ও সৌন্দৰ্য । প্রশ্ন উঠবে, গদ্য তা হলে কাব্যের পর্যায়ে উঠবে কোন নিয়মে। এর উত্তর সহজ । গদ্যকে যদি ঘরের গৃহিণী বলে কল্পনা কর তা হলে জানবে, তিনি তর্ক করেন, ধোবার বাড়ির কাপড়ের হিসাব রাখেন, তার কাশি সর্দি জ্বর প্রভৃতি হয়, "মাসিক বসুমতী’ পাঠ করে থাকেন- এ-সমস্তই প্রাত্যহিক হিসেব, সংবাদ্রের কোঠার অন্তর্গত, এই ফাকে ফাকে মাধুরীর স্রোত উছলিয়ে ওঠে, পাথর ডিঙিয়ে ঝরনার মতো । সেটা সংবাদের বিষয় নয়, সে সংগীতের শ্রেণীয়। গদ্যকাব্যে তাকে বাছাই করে নেওয়া যায় অথবা সংবাদের সঙ্গে সংগীত মিশিয়ে দেওয়া চলে । সেই মিশ্রণের উদ্দেশ্য সংগীতের রসকে পরুষের স্পর্শে ফেনায়িত উগ্রতা দেওয়া । শিশুদের সেটা পছন্দ না হতে পারে, কিন্তু দৃঢ়ব্দন্ত বয়স্কের রুচিতে এটা উপাদেয় । আমার শেষ বক্তব্য এই যে, এই জাতের কবিতায় গদ্যকে কাব্য হতে হবে । গদ্য লক্ষ্যভ্ৰষ্ট হয়ে কাব্য পর্যন্ত পৌঁছল না, এটা শোচনীয়। দেবসেনাপতি কার্তিকেয় যদি কেবল স্বয়ীয় পালোয়ানের আদর্শ হতেন তা হলে শুম্ভনিশুম্ভের চেয়ে উপরে উঠতে পারতেন না । কিন্তু, তার পৌরুষ যখন কমনীয়তার সঙ্গে মিশ্রিত হয় তখনই তিনি দেব সাহিত্যে গদাকাব্যের সিংহাসনের উপযুক্ত হন। (দোহাই তোমার, বাংলাদেশের ময়ুরে-চড়া কাৰ্তিকটিকে সম্পূৰ্ণ ভোলবার চেষ্টা কোরো ।) S ዓ Qw S እ 96