পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৪৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পারস্যে &ኃS ዔ বাকি তিনজন পালাক্রমে তরী-চালনায় নিযুক্ত, মাঝে মাঝে যাত্রার দফতর লেখা, কিছু-বা আহার, কিছু-বা তন্দ্ৰা । ক্ষুদ্র এক টুকরো সিজনতা নীচের পৃথিবী থেকে ছিটকে পড়ে উড়ে চলেছে অসীম জনশূন্যতায় । জাহাজ ক্রমে উর্ধ্বতর আকাশে চড়ছে, হাওয়া চঞ্চল, তরী টলেমিলে। ক্রমে বেশ একটু শীত করে এল। নীচে পাথুরে পৃথিবী, রাজপুতানার কঠিন বন্ধুরতা শুষ্ক শ্ৰোতঃপথের শীর্ণ রেখাজালে অঙ্কিত, যেন গেরুয়া-পরা বিধবাভূমির নির্জলা একাদশীর চেহারা । অবশেষে অপরাহুে দূর থেকে দেখা গেল রুক্ষ মরুভূমির পাংশুল বক্ষে যোধপুর শহর । আর তারই প্ৰান্তরে যন্ত্রপাখির ই-করা প্ৰকাণ্ড নীড় । নেমে দেখি এখানকার সচিব কুনবার মহারাজ সিং সন্ত্রীক আমাদের অভ্যর্থনার জন্য উপস্থিত, তখনই নিয়ে যাবেন তাদের ওখানে চা-জলযোগের আমন্ত্রণে । শরীরের তখন প্ৰাণধারণের উপযুক্ত শক্তি কিছু ছিল, কিন্তু সামাজিকতার উপযোগী উদ্যবৃত্ত ছিল না। বললেই হয় । কষ্টে কর্তব্য সেরে হােটেলে এলুম। হোটেলটি বায়ুতরীযাত্রীর জন্যে মহারাজের প্রতিষ্ঠিত। সন্ধ্যাবেলায় তিনি দেখা করতে এলেন । ষ্ঠার সহজ সৌজন্য রাজ্যোচিত । মহারাজ স্বয়ং উড়োজাহাজ-চালনায় সুদক্ষ । তার যতরকম দুঃসাহসী কৌশল আছে প্ৰায় সমস্তই তার অভ্যন্ত ! পরের দিন ১২ই এপ্রেল ভোর রাত্রে জাহাজে উঠতে হল। হাওয়ার গতিক পূর্ব দিনের চেয়ে ভালোই। অপেক্ষাকৃত সুস্থ শরীরে মধ্যাহ্নে করাচিতে পুরবাসীদের আদর-অভ্যর্থনার মধ্যে গিয়ে পৌছনো গেল । সেখানে বাঙালি গৃহলক্ষ্মীর সযত্নপক অন্ন ভোগ করে আধা ঘণ্টার মধ্যে জাহাজে উঠে পড়লুম। সমুদ্রের ধার দিয়ে উড়ছে জাহাজ। বা দিকে নীল জল, দক্ষিণে পাহাড়ে মরুভূমি । যাত্রার শেষ অংশে বাতাস মেতে উঠল । ডাঙায় বাতাসের চাঞ্চল্য নানা পদার্থের উপর আপনি পরিচয় দেয় । এখানে তার একমাত্র প্রমাণ জাহাজটার ধড়ফড়ানি । বহুদূর নীচে সমুদ্রে ফেনার সাদা রেখায় একটু একটু তুলির পোচ দিচ্ছে । তার না শুনি গর্জন, না দেখি তরঙ্গের উত্তালত । এইবার মরুদ্বার দিয়ে পারস্যে প্রবেশ । বুশেয়ার থেকে সেখানকার গবর্নর বেতারে দূরলিপিযোগে অভ্যর্থনা পাঠিয়েছেন । করাচি থেকে অল্প সময়ের মধ্যেই ব্যোমতয়ী জাস্কে পৌছল। সমুদ্রতীরে মরুভূমিতে এই সামান্য গ্রামটি । কাদায় তৈরি গোটাকতক চৌকো চ্যাপটা-ছাদের ছোটাে ছোটাে বাড়ি ইতস্ততবিক্ষিপ্ত, যেন মাটির সিন্দুক । আকাশযাত্রীদের পান্থশালায় আশ্রয় নিলুম। রিক্ত এই ভূখণ্ডে নীলাম্বুচুম্বিত বালুরাশির মধ্যে বৈচিত্র্যসম্পদ কিছুই নেই। সেইজন্যেই বুঝি গোধূলিবেলায় দিগঙ্গনার স্নেহ দেখলুম। এই গরিব মাটির 'পরে । কী সুগভীর সূর্যস্ত, কী তার দীপ্যমান শান্তি, পরিব্যাপ্ত মহিমা । স্নান করে এসে বারান্দায় বসলাম, স্নিগ্ধ বসম্ভের হাওয়া ক্লান্ত শরীরকে নিবিড় আরামে বেষ্টন করে ধরলে । এখানকার রাজকর্মচারীর দল সম্মানসম্ভাষণের জন্যে এলেন । বাইরে বালুতটে আমাদের চৌকি পড়েছে। যে দুই-একজন ইংরেজি জানেন তাদের সঙ্গে কথা হল । বোঝা গেল পুরাতনের খোলস বিদীর্ণ করে পারস্য আজ নূতন প্ৰাণের পালা আরম্ভ করতে প্ৰস্তুত । প্রাচ্য জাতির মধ্যে যেখানে জাগরণের চাঞ্চল্য সেখানে এই একই ভাব । অতীতের আবর্জনামুক্ত সমাজ, সংস্কারমুক্ত চিত্ত, বাধামুক্ত মানবসম্বন্ধের ব্যাপ্তি, বাস্তব জগতের প্রতি মোহমুক্ত বৈজ্ঞানিক, দৃষ্টি, এই তাদের সাধনার প্রধান লক্ষ্য । তারা জানে, হয়। বর্তমান কালের শিক্ষা নয়। তার সাংঘাতিক আঘাত আমাদের গ্রহণ করতে হবে । অতীত কালের সঙ্গে যাদের দুশোচ্ছদ্য দ্বিবন্ধনের জটিলতা, মৃত যুগের সঙ্গে আজ তাদের সহমরণের আয়োজন ।