পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৫৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VVS)r রবীন্দ্র-রচনাবলী পৌঁছবার আশা নেই, তাই পথে কোনরতাখতে নামে এক জায়গায় প্রহরীদের মেটে আড়ায় আমাদের মোটর গাড়ি থামল। মাটির মেঝের 'পরে তাড়াতাড়ি কম্বল কাপেট বিছিয়ে দিলে। সঙ্গে আহার্য ছিল, খেয়ে নিলুম। মনে হল, এ যেন বইয়ে পড়া গল্পের পান্থশালা, খেজুর-কুঞ্জের মাঝখানে । এবার পাহাড়ে আঁকাবঁকা চড়াই পথে উঠছি। পাহাড়গুলো সম্পূর্ণটাক-পড়া, এমন-কি, পাথরেরও প্রাধান্য কম। বড়ো বড়ো মাটির ভূপ। যেন মুড়িয়ে দেওয়া দৈত্যের মাথা। বোঝা যায় এটা বৃষ্টিবিরল দেশ, নইলে গাছের শিকড় যে মাটিকে বেঁধে রাখে নি বৃষ্টির আঘাতে সে মাটি কতদিন টিকতে পারে। স্বল্পপথিক পথে মাঝে মাঝে কেরোসিনের বোঝা নিয়ে গাধা চলেছে । বোঝাই-করা বড়ো বড়ো সরকারি মোটর বাস আমাদের পথ বাচিয়ে নড়বড় করে ছুটেছে নীচের দিকে । পাহাড়ের পর পাহাড়, তৃণহীন জনহীন রুক্ষ, যেন পৃথিবীর বুক থেকে একটা তুষার্ত দৈন্যের অশ্রুহীন কাল্লা ফুলে ফুলে উঠে vsp zKGs (5fQR | বেলা যায় । এক জায়গায় দেখি পথের মধ্যে খজেরুনের গবর্নর ঘোড়সওয়ার পাঠিয়েছেন আমাদের আগিয়ে নিয়ে যাবার জন্যে । বোঝা গেল তারা অনেকক্ষণ ধরে প্রতীক্ষা করছেন । প্রাসাদে পৌঁছালুম। বড়ো বড়ো কমললেবুগাছের ঘনসংহত বীথিক ; সিন্ধাচ্ছায়ায় চোখ জুড়িয়ে দিলে । সেকালের মনোরম বাগান, নাম বাগ-ই-নজর । নিঃস্ব রিক্ততার মাঝখানে হঠাৎ এইরকম সবুজ ঐশ্বর্যের দানসত্ৰ, এইটেই পারস্যের বিশেষত্ব । বাগানের তরুতলে আমাদেৱ ভোজের আয়োজন । কিন্তু এখনকার মতো ব্যর্থ হল । আমি নিরতিশয় ক্লান্ত । একটি কাপেট-বিছানো ছোটাে ঘরে খাটের উপর শুয়ে পড়লুম। বাতাসে তাপ নেই, সামনে খোলা দরজা দিয়ে ঘন সবুজের উচ্ছস চোখে এসে পড়ছে। কিছুক্ষণ পরে বিছানা ছেড়ে বাগানে গিয়ে দেখি, গাছতলায় বড়ো বড়ো ডেকচিতে মোটা মোটা পাচক রান্না চড়িয়েছে, আমাদের দেশে যজ্ঞের রান্নার মতো । বুঝলুম রাত্রিভোজের উদ্যোগপর্ব । অতিথির সম্মানে আজ এখানে সরকারি ছুটি । সেই সুযোগে অনেকক্ষণ থেকে লোক জমায়েত হয়েছিল । আমাদের দেরি হওয়াতে ফিরে গেছে । যারা বাকি আছেন তাদের সঙ্গে বসে গেলুম। সকলেরই মুখে তাদের রাজার কথা । বললেন, তিনি অসামান্য প্রতিভার জোরে দশ বছরের মধ্যে পারস্যের চেহারা বদলিয়ে দিয়েছেন । এইখানে আধুনিক পারস্য-ইতিহাসের একটুখানি আভাস দেওয়া যেতে পারে । কাজার-জাতীয় আগা মহম্মদ খাঁর দানবিক নিষ্ঠুরতায় এই ইতিহাসের বর্তমান অধ্যায় আরম্ভ হল। এরা পারসিক নয় । কাজাররা তুর্কিজাতের লোক । তৈমুরলঙ, এদের পারস্যে নিয়ে আসে । বর্তমানে রেজা শা পহলবীর আমলের পূর্ব পর্যন্ত পারস্যের রাজসিংহাসন এইজাতীয় রাজাদের হাতেই ছিল । উনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে শী নাসিরউদ্দিন ছিলেন রাজা । তখন থেকে রাষ্ট্রবিপ্লবের সূচনা দেখা দিল । এই সময়ে পারস্যের মন যে জেগে উঠেছে তার একটা নিদর্শন দেখা যায় বাবিপন্থীদের ধর্মবিপ্লবে । ঠিক এই সময়েই রামমোহন রায় বাংলাদেশে প্রচার করেছিলেন ধর্মসংস্কার । নাসিরউদ্দিন অতি নিষ্ঠুরভাবে এই সম্প্রদায়কে দালন করেন । পারস্যের রাজাদের মধ্যে নাসিরউদ্দিন প্রথম যুরোপে যান। আর তার আমল থেকেই দেশকে বিদেশীর ঋণজালে জড়িত করা শুরু হল। তার ছেলে মজফফরউদ্দিনের আমলে এই জাল বিস্তৃত হবার দিকে চলল। তামাকের ব্যাবসার একচেটি অধিকার তিনি দিলেন এক ইংরেজ কোম্পানিকে । এটা দেশের লোকের সাইল না, তারা তামাক বয়কট করে দিলে। দেশসূদ্ধ তামাকখোরদের তামাক ছাড়া সোজা নয়, কিন্তু তাও ঘটল । এই উপায়ে এটা রদ হয়ে গেল, কিন্তু দণ্ড দিতে হল কোম্পানিকে খুব লম্বা মাপে । তার পরে লাগল রাশিয়া, তার হাতে রেলওয়ে । বেলজিয়াম থেকে কর্মচারী এল পারস্যে ট্যাক্স আদায়ের কাজে, ইংরেজও উঠে পড়ে লাগল “পারস্যবিভাগের কাজে । এ দিকে দেশের লোকের কাছ থেকে ক্রমাগত তাগিদ। আসছে। রাষ্ট্রসংস্কারের । শেষকালে রাজাকে