পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৫৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পারস্যে V8S কারণ, আপনারা যে ভাষায় আমাকে সম্ভাষণ করলেন সে আপনাদের নিজের, আমার এই ভাষা ধার করা । জমার খাতায় আমার তরফে একটিমাত্র অঙ্ক উঠল, সে হচ্ছে এই যে, আমি সশরীরে এখানে উপস্থিত । বঙ্গাধিপতি একদা কবি হাফেজকে বাংলায় নিমন্ত্ৰণ করেছিলেন, তিনি যেতে পারেন নি । বাংলার কবি পারস্যাধিপের নিমন্ত্ৰণ পেলে, সে নিমন্ত্রণ রক্ষাও করলে এবং পারস্যকে তার শ্ৰীতি ও শুভকামনা প্রত্যক্ষ জানিয়ে কৃতাৰ্থ হল । সভার পালা শেষ হলে পর চললেম গবর্নরের প্রাসাদে। পথে যে শিরাজের পরিচয় হল সে নূতন শিরাজ। রান্তা ঘরবাড়ি তৈরি চলছে। পারস্যের শহরে শহরে এই নৃতন রচনার কাজ সর্বত্রই জেগে উঠল, নূতন যুগের অভ্যর্থনায় সমস্ত দেশ উৎসাহিত । সৈনিকপঙক্তির মধ্য দিয়ে বৃহৎ প্রাঙ্গণ পার হয়ে গবর্নরের প্রাসাদে প্রবেশ করলেম । মধ্যাহ্নভোজনের আয়োজন সেখানে অপেক্ষা করছে। কিন্তু অন্য সকল অনুষ্ঠানের পূর্বেই যাতে বিশ্রাম করতে পারি। সেই প্রার্থনামতই ব্যবস্থা হল । পরিষ্কার হয়ে নিয়ে আশ্রয় নিলুম শোবার ঘরে । তখন বেলা চারটে । রাত্রে নিমত্রিতবর্গের সঙ্গে আহার করে দীর্ঘদিনের অবসান । সকালে গবর্নর বললেন, কাছে এক ভদ্রলোকের বাগানবাড়ি আছে, সেটা আমাদের বাসের জন্য প্ৰস্তৃত । সেখানেই আমার বিশ্রামের সুবিধা হবে বলে বাসা-বাদল স্থির হল । ১৭ এপ্ৰেল । আজ অপরাহুে সাদির সমাধিপ্রাঙ্গণে আমার অভ্যর্থনার সভা । গবর্নর প্রথমে নিয়ে গেলেন চেম্বার অফ কমার্সে। সেখানে সদস্যদের সঙ্গে বসে চা খেয়ে গেলেম সাদির সমাধিস্থানে । পথের দুই ধারে জনতা । কালো কালো আঙরাখায় মেয়েদের সর্বাঙ্গ ঢাকা, মুখেরও অনেকখানি, কিন্তু বুরখ নয়। সাধারণত পুরুষদের কাপড় যুরোপীয়, কচিৎ দেখা গেল পাগড়ি ও লম্বা কাপড়। বর্তমান রাজার আদেশে দেশের পুরুষেরা যে টুপি পরেছে তার নাম পহলবী টুপি । সেটা কপালের সামনে কানা-তোলা কাপ । আমাদের গান্ধিটুিপি যেমন শ্ৰীহীন ভারতের-প্রথা-বিরুদ্ধ ও বিদেশী-ঘেঁষা এও সেইরকম । কমিষ্ঠতার যুগে সাজের বাহুল্য স্বভাবতই খসে পড়ে। তা ছাড়া একেলে বেশ শ্রেণী:নির্বিশেষে বড়ো ছোটাে সকলেরই সুলভ ও উপযোগী হবার দিকে ঝোকে । যুরোপে একদা দেশে দেশে, এমন-কি, এক দেশেই, বেশের বৈচিত্ৰ্য যথেষ্ট ছিল । অথচ সমস্ত যুরোপ আজ এক পোশাক পরেছে, তার কারণ সমস্ত যুরোপের উপর দিয়ে বয়েছে একই হাওয়া । সময় অল্প, কাজের তাড়া বেশি, তার উপর সামাজিক শ্রেণীভেদ হালকা হয়ে এসেছে। আজ যুরোপের বেশ শুধু যে শক্ত মানুষের, তৎপর মানুষের তা নয়, এ বেশ সাধারণ মানুষের- যারা সবাই একই বড়োরাস্তায় চলে। আজ পারস্য তুরুস্ক ঈজিপ্ট এবং আরবের যে অংশ জেগেছে। সবাই এই সর্বজনীন উদি। গ্রহণ করেছে, নইলে বুঝি মানের বদল সহজ হয় না। জাপানেও তাই। আমাদেরও ধুতি-পরা ঢিলে মন বদল করতে হলে হয়তো-বা পোশাক বদলানো দরকার। আমরা বহুকাল ছিলুম। বাবু, হঠাৎ হয়েছি। খণ্ড-ত-ওয়ালা শ্ৰীযুৎ অথচ বাবুর দোদুল্যমান বেশই কি চিরকাল থাকবে । ওটাতে যে বসন্যবাহুল্য আছে সেটা যাই যাই করছে, হাঁটু পর্যন্ত ছাঁটা পায়জামা দ্রুতবেগে এগিয়ে আসছে। যুগের হুকুম শুধু মনে নয়, গায়ে এসেও লািগল । মেয়েদের বেশে পরিবর্তনের ধাক্কা এমন করে লাগে নি- কেননা মেয়েরা অতীতের সঙ্গে বর্তমানের সেতু, পুরুষরা বর্তমানের সঙ্গে ভবিষ্যতের। সাদির সমাধিতে স্থাপত্যের গুণাপনা কিছুই নেই। আজকের মতো ফুল দিয়ে প্ৰদীপ দিয়ে কবরস্থান সাজানো হয়েছে। সেখান থেকে সমাধির পশ্চাতে প্ৰশন্ত প্রাঙ্গণে বৃহৎ জনসভার মধ্যে গিয়ে আসন নিলুম। চত্বরের সামনে সমুচ্চ প্রাচীর অতি সুন্দর বিচিত্র কাপেটে আবৃত করা হয়েছে, মেজের উপরেও কাপেট পাতা । সভান্থ সকলেরই সামনে প্রাঙ্গণ ঘিরে ফল মিষ্টান্ন সাজানো । সভার ডান দিকে নীলাভ পাহাড়ের প্রান্তে সূর্য অন্তোন্মুখ । বামে সভার বাইরে পথের ওপারে উচ্চভূমিতে ভিড় জমেছে- অধিকাংশই কালো কাপড়ে আচ্ছন্ন স্ত্রীলোক, মাঝে মাঝে বন্দুকধারী প্রহরী।