পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৬৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Ve 88 রবীন্দ্র-রচনাবলী না । বৈচিত্র্যহীন রিক্ততার মধ্য দিয়ে যে পথ চলেছে একেবেকে সেটা মোটর-রথের পক্ষে প্রশস্ত ও অপেক্ষাকৃত অবন্ধুর । প্ৰায় এক ঘণ্টার পথ পেরিয়ে বায়ে দেখা গেল শস্যখেত, গম এবং আফিম । কিন্তু গ্রাম দেখি নে, দিগন্ত পর্যন্ত অবারিত । মাঝে মাঝে ঝাকড়া-লোম-ওয়ালা ভেড়ার পাল, কোথাও-বা ছাগলের কালো রোয়ায় তৈরি চৌকো। তাঁবু । শস্যশ্যামল মাঠ ক্রমে প্রশস্ত হয়ে চলেছে । দুরের পাহাড়গুলো খাটাে হয়ে এল, যেন তার পাহাড়ের শাবক । এমন সময় হঠাৎ দেখা গেল অনতিদূরে পার্সিপোলিস । দিগ বিজয়ী দরিয়ুসের প্রাসাদের ভগ্নশেষ । উচ্চ মাটির মঞ্চ, তার উপরে ভাঙা ভাঙা বড়ো বড়ো পাথরের থাম, অতীত মহাযুগ যেন আকাশে অক্ষম বাহু তুলে নির্মম কালকে ধিককার দিচ্ছে । আমাকে চৌকিতে বসিয়ে পাথরের সিডি বেয়ে তুলে নিয়ে গেল। পিছনে পাহাড়, উধের্ণ শূনা, নীচে দিগম্ভপ্রসারিত জনশূন্য প্রান্তর, তারই প্রান্তে দাড়িয়ে আছে এই পাথরের রুদ্ধবাণীর সংকেত । বিখ্যাত পুরাবশেষবিৎ জার্মান ডাক্তার হটজফেলটি এই পুরাতন কীর্তি উদঘাটন করবার কাজে নিযুক্ত । তিনি বললেন, বর্লিনে আমার বক্তৃতা শুনেছেন আর হােটেলেও আমার সঙ্গে তিনি দেখা করতে gिशछिgब्जन्म । পাথরের থামগুলো কোনোটা ভাঙা, কোনোটা অপেক্ষাকৃত সম্পূৰ্ণ । নিরর্থক দাড়িয়ে ছড়িয়ে, মজিয়মে অতিকায় জন্তুর অসংলগ্ন অস্থিাগুলোর মতো । ছাদের জন্য যে-সব কাঠ লেগেছিল, হিসাবের তালিকায় দেখা গেছে, ভারতবর্ষ থেকে আনীত সেগুন কাঠও ছিল তার মধ্যে । খিলেন বানাবার বিদ্যা তখন জানা ছিল না বলে পাথরের ছাদ সম্ভব হয় নি । কিন্তু যে বিদার জোরে এই-সকল গুরুভার অতি প্ৰকাণ্ড পাথরগুলি যথাস্থানে বসানো হয়েছিল সে বিদ্যা আজ সম্পূৰ্ণ বিস্মৃত । দেখে মনে পড়ে মহাভারতের ময়দানবের কথা । বোঝা যায় বিশাল প্ৰাসাদ-নির্মাণের বিদ্যা যাদের জানা ছিল তারা যুধিষ্ঠিরের স্বজাতি ছিল না । হয়তো-বা। এই দিক থেকেই রাজমিস্ত্ৰি গেছে । যে পুরোচন পাণ্ডবদের জন্যে সুড়ঙ্গ বানিয়েছিল। সেও তো যবন । ডাক্তার বললেন, আলেকজান্ডার এই প্ৰাসাদ পুড়িয়ে ফেলেছিলেন সন্দেহ নেই। আমার বোধ হয় পরকীর্তি-অসহিষ্ণু ঈর্ষাই তার কারণ। তিনি চেয়েছিলেন মহাসাম্রাজ্য স্থাপন করতে, কিন্তু মহাসাম্রাজ্যের অভ্যুদয় তার আগেই দেখা দিয়েছিল । আলেকজান্ডার আকেমেনীয় সম্রাটদের পারস্যকে লণ্ডভণ্ড করে গিয়েছেন । এই পার্সিপোলিসে ছিল দরিয়ুসের গ্রন্থাগার । বহু সহস্ৰ চৰ্মপত্রে রুপালি সোনালি অক্ষরে তাদের ধর্মগ্রন্থ আবেস্তা লিপীকৃত হয়ে এইখানে রক্ষিত ছিল । যিনি এটাকে ভস্মসাৎ করেছিলেন তার ধর্ম এর কাছে বর্বরতা । আলেকজান্দার আজ জগতে এমন কিছুই রেখে যান নি যা এই পার্সিপোলিসের ক্ষতিপূরণ-স্বরূপে তুলনীয় হতে পারে। এখানে দেয়ালে ক্ষোদিত মূর্তিশ্রেণীর মধ্যে দেখা যায় দরিয়াসু আছেন রাজছত্ৰতলে, আর তার সম্মুখে বন্দী ও দাসেরা অর্ঘ্য বহন করে আনছে । পরবর্তীকালে ইস্ফাহানের কোনো উজির এই শিলালেখ্য ভেঙে বিদীর্ণ বিকলাঙ্গ করে দিয়েছে । পারস্যে আর-এক জায়গা খনন করে প্রাচীনতর বিস্মৃত যুগের জিনিস পাওয়া গেছে । অধ্যাপক তারই একটি নকশা-কাটা ডিমের খোলার পাত্র আমাকে দেখালেন । বললেন, মহেঞ্জোদারোর যেরকম কারুচিত্র এও সেই জাতের । সার অরেলস্টাইন মধ্য-এশিয়া থেকেও এমন কিছু কিছু জিনিস পেয়েছেন মহেঞ্জোদারোয় যার সাদৃশ্য মেলে। এইরকম বহুদূরবিক্ষিপ্ত প্রমাণগুলি দেখে মনে হয় আধুনিক সকল সভ্যতার পূর্বে একটা বড়ো সভ্যতা পৃথিবীতে তার লীলা বিস্তার করে অন্তর্ধান করেছে । অধ্যাপক এই ভগ্নশেষের এক অংশ সংস্কার করে নিজের বাসা করে নিয়েছেন । ঘরের চারি দিকে লাইব্রেরি এবং নানাবিধ সংগ্ৰহ । দরিয়ুস জারাক্সিস এবং আর্টাজারিক্সাস এই তিন-পুরুষ-বাহী সম্রাটের লপ্তশেষ সম্পদের উত্তরাধীকারী হয়ে অধ্যাপক নিভৃতে খুব আনন্দে আছেন ।