পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৬৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পারস্যে と8(? এ দেশে আসবামাত্র সব চেয়ে লক্ষ্য করা যায় পূর্ব-এশিয়ার সঙ্গে পশ্চিম-এশিয়ার প্রাকৃতিক চেহারার সম্পূর্ণ পার্থক্য । উভয়ে একেবারেই বিপরীত বললেই হয়। আফগানিস্তান থেকে আরম্ভ করে মেসোপেটেমিয়া হয়ে আরব পর্যন্ত নির্দয়ভাবে নীরস কঠিন । পূর্ব-এশিয়ার গিরি শ্রেণী ধরণীর প্রতিকূলতা করে নি, তাদেরই প্ৰসাদবর্ষণে সেখানকার সমস্ত দেশ পরিপুষ্ট । কিন্তু পশ্চিমে তারা পৃথিবীকে বন্ধুর করেছে এবং অবরুদ্ধ করেছে আকাশের রসের দৌত্য । মাঝে মাঝে খণ্ড খণ্ড বিক্ষিপ্ত আকারে এখানকার অনাদৃত মাটি উর্বরতার স্পর্শ পায়, দুর্লভ বলেই তার লোভনীয়তা প্রবল, মনোহর তার রমণীয়তা । সৌভাগ্যক্রমে এরা বাহন পেয়েছে। উট এবং ঘোড়া, আর জীবিকার জনো পালন করেছে ভেড়ার পাল । এই জীবিকার অনুসরণ করে এখানকার মানুষকে নিরন্তর সচল হয়ে থাকতে হল । এই পশ্চিম-এশিয়ার অধিবাসীরা বহু প্ৰাচীনকাল থেকেই বারে বারে বড়ো বড়ো সাম্রাজ্য স্থাপন করেছেতার মূল প্রেরণা পেয়েছে এখানকার ভূমির কঠোরতা থেকে, যা তাদের বাইরে ঠেলে বের করে দেয় । তারা প্ৰকৃতির অযাচিত আতিথ্য পায় নি, তাদের কেডে খেতে হয়েছে। পরের অন্ন, আহার সংগ্ৰহ করতে হয়েছে নূতন নূতন ক্ষেত্রে এগিয়ে এগিয়ে । এখানে পল্লীর চেয়ে প্রাধান্য দুৰ্গরক্ষিত প্রাচীরবেষ্টিত নগরের ; কত প্রাচীন রাজধানীর ধ্বংস শেষ পাশ্চাত্য এশিয়ায় ধূলিপরিকীর্ণ । কৃষিজীবীদের স্থান পল্লী, সেখানে ধন স্বহস্তে উৎপাদন করতে হয় । নগর প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে জয়জীবী যোদ্ধাদের প্রতাপের উপরে । সেখানে সম্পদ সংগ্রহ ও রক্ষণ না করলে পরাভব । ভারতবর্ষে কৃষিজীবিকার সহায় গোরু, মধ্য ও পশ্চিম -এশিয়ায় জয়জীবিকার সহায় ঘোড়া ! পৃথিবীতে কী মানুষের, কী বাহনের, কী অস্ত্রের তুরিত গতিই জয়সাধনের প্রধান উপায় । তাই একদিন মধ্য-এশিয়ার মরুবাহী অশ্বপাল মোগল বর্বরেরা বহুদূর পৃথিবীতে ভীষণ জয়ের সর্বনেশ আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল । চিরাচলিষ্ণুতাই তাদের করে তুলেছিল দুর্ধর্ষ । অন্নসংকোচের জন্যেই এরা এক-একটি জ্ঞাতিজাতিতে বিভক্ত, এই জ্ঞাতিজাতির মধ্যে দুৰ্ভেদ্য ঐকা । যে কারণেই হোক, তাদের এই ঐক্য যখন বহু শাখাধারার সম্মিলিত ঐকো স্ফীত হয়েছে তখন তাদের জয়বেগকে কিছুতে ঠেকাতে পারে নি । বিক্ষিপ্ত বিচ্ছিন্ন আরবীয় মরুবাসী জ্ঞাতিজাতির যখন এক অখণ্ড ধর্মের ঐকে এক দেবতার নামে মিলেছিল তখন অচিরকালের মধ্যেই তাদের জয়পতাকা উড়েছিল কালবৈশাখীর রক্তরাগারঞ্জিত মেঘের মতো দূর পশ্চিমদিগন্ত থেকে দূর পূর্বদিকপ্রান্ত পর্যন্ত । একদা আর্যজাতির এক শাখা পর্বতবিকীর্ণ মরুবেষ্টিত পারস্যের উচ্চভূমিতে আশ্রয় নিলে । তখন কোনো-এক অজ্ঞাতনামা সভ্যজাতি ছিল এখানে । তাদের রচিত যে-সকল কারুদ্রব্যের চিহ্নশেষ। পাওয়া যায় তার নৈপুণ্য বিস্ময়জনক । বোধ করি বলা যেতে পারে। মহেঞ্জোদারো-যুগের মানুষ । তাদের সঙ্গে এদের হাতের কাজের মিল আছে । এই মিল এশিয়ায় বহুদূরবিস্তৃত । মহেজাদারোর স্মৃতিচিহ্নের সাহায্যে তৎকালীন ধর্মের যে চেহারা দেখতে পাই অনুমান করা যায়, সে বৃষভবাহন শিবের ধর্ম । রাবণ ছিলেন শিবপূজক, রাম ভেঙেছিলেন শিবের ধনু । রাবণ যে জাতের মানুষ সে জাতি না ছিল অরণ্যচর, না ছিল পশুপালক । রামায়ণগত জনশ্রুতি থেকে বোঝা যায়, সে জাতি পরাভূত দেশ থেকে ঐশ্বৰ্যসংগ্রহ করে নিজের রাজধানীকে সমৃদ্ধ করেছে এবং অনেকদিন বাহুবলে উপেক্ষা করতে পেরেছে আৰ্যদেবতা ইন্দ্ৰকে । সে জাতি নগরবাসী । মহেজাদারোর সভ্যতাও নাগরিক । ভারতের আদিম আরণ্যক বর্বরতর জাতির সঙ্গে যোগ দিয়ে আর্যেরা এই সভ্যতা নষ্ট করে । সেদিনকার দ্বন্ধের একটা ইতিহাস আছে। পুরাণকথায়, দক্ষযজ্ঞে । একদা বৈদিক হােমের আগুন নিবিয়েছিল শিবের উপাসক, আজও হিন্দুরা সে উপাখ্যান পাঠ করে ভক্তির সঙ্গে । শৈব ও বৈষ্ণব ধর্মের কাছে বৈদিক দেবতার খর্বতার কথা গৌরবের সঙ্গে পৌরাণিক ভারতে আখ্যাত হয়ে থাকে । খৃস্টজন্মের দেড়হাজার বছর পূর্বে ইরানী আৰ্যরা পারস্যে এসেছিলেন, য়ুরোপীয় ঐতিহাসিকদের এই মত । তাদের হােমাগ্নির জয় হল । ভারতবর্ষ বৃহৎ দেশ, উর্বর, জনসংকুল । সেখানকার আদিম জাতের নানা ধর্ম, নানা রীতি তার সঙ্গে জড়িত হয়ে বৈদিক ধর্ম আচ্ছন্ন পরিবর্তিত ও অনেক অংশে