পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৬৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পারস্যে V98Գ বা রাজবংশে সাম্রাজ্যভার অতি দীর্ঘকাল বহন করবার শক্তি টিকে থাকতেই পারে না । কেননা সাম্রাজ্য পদার্থটাই অস্বাভাবিক, যে এককগুলির সমষ্টিতে সেটা গঠিত তাদের মধ্যে ঐকান্তিকতা নেই, জবৰ্দন্তির সম্বন্ধ বিচ্ছিন্ন হবার জন্যে ভিতরে ভিতরে নিরন্তর চেষ্টা করে, তা ছাড়া বহুবিস্তৃত সীমানা বহুবিচিত্র বিবাদের সংস্রবে। আসতে থাকে । আকেমেনীয় সাম্রাজ্যও আপনি গুরুভারে ক্রমেই হীনবল হয়ে অবশেষে আলেকজান্ডারের হাতে চরম আঘাত পেলে । এক আঘাতেই সে পড়ে গেল তার একমাত্র কারণ আলেকজান্দার নয় । অতি বৃহদাকার প্রতাপের দুর্ভর ভার ব্রাহকেরা একদিন নিশ্চিত বর্জন করতে বাধ্য, ভগ্ন-উরু ধূলিশায়ী মৃত দুৰ্যোধনের মতো ভগ্নাবশিষ্ট পার্সিপোলিস এই তত্ত্ব আজ বহন করছে । আলেকজান্দারের জোড়াতাড়া-দেওয়া সাম্রাজ্যও অল্পকালের আয়ু নিয়েই সেই তত্ত্বের উত্তরাধিকারী হয়েছিল সে কথা সুবিদিত । এখান থেকে আর এক ঘণ্টার পথ গিয়ে সাদাতাবাদ গ্রামে আমাদের মধ্যাহ্নভোজন। একটি বড়ো রকমের গ্রাম, পথের দুই ধারে ঘনসংলগ্ন কাচা ইটের ও মাটির ঘর, দোকান ও ভোজনশালা । পেরিয়ে গিয়ে দেখি পথের ধারে ডান পাশে মাটি ছেয়ে নানা রঙের মেঠোফুল ভিড় করে আছে। দীর্ঘ এলম বনস্পতির ছায়াতলে তন্ত্রী জলধারা স্নিগ্ধ কলশব্দে প্রবাহিত । এই রমণীয় উপবনে ঘাসের উপর কাপেট বিছিয়ে আহার হল । পোলাও মাংস ফল ও যথেষ্ট পরিমাণে ঘোল । আকাশে মেঘ জমে আসছে । এখান থেকে নকবই মাইল পরে আবাদে-নামক ছোটো শহর, সেখানে রাত্রিযাপনের কথা । দূরে দেখা যাচ্ছে তুষাররেখার-তিলক-কাটা গিরিশিখর। দেহবিদ গ্রাম ছাড়িয়ে সুর্মাকে পৌঁছলুম। পথের মধ্যে সেখানকার প্রধান রাজকর্মচারী অভ্যর্থনা জানিয়ে আগে চলে গেলেন । বেলা পাচটার সময় পৌছলুম পুরপ্রাসাদে । কাল ভোরের বেলা রওনা হয়ে ইন্ফাহানে পৌঁছব দ্বিপ্রহবে । যারা খাটি ভ্ৰমণকারী তারা জােতই আলাদা । এক দিকে তাদের শরীর মন চিরাচলিফু, আর-এক দিকে অনভাস্তের মধ্যে তাদের সহজ বিহার । যারা শরীরটাকে স্তন্ধ রেখে মনটাকে চালায় তারা অন্য শ্রেণীর লোক । অথচ রেলগাড়ি-মোটরগাড়ির মধ্যস্থতায় এই দুই জাতের পঙক্তিভেদ রইল না। কুনো মানুষের ভ্ৰমণ আপনি কোণ থেকে আপন কোণেই আসবার জন্যে । আমাদের আধ্যাত্মিক ভাষায় যাদের বলে কনিষ্ঠ অধিকারী । তারা বাধা বাস্তায় সন্তায় টিকিট কেনে, মনে করে মুক্তিপথে ভ্ৰমণ সারা হল, কিন্তু ঘটা করে ফিরে আসে সেই আপনি সংকীর্ণ আডডায়, লাভের মধ্যে, হয়তো সংগ্রহ করে অহংকার । ভ্রমণের সাধনা আমার ধাতে নেই, অন্তত এই বয়সে। সাধক যারা, দুৰ্গমতার কৃচ্ছসাধনে তাদের স্বভাবের আনন্দ, পথ খুঁজে বের করবার মহৎ ভার তাদের উপর । তারা শ্রেষ্ঠ অধিকারী, ভ্রমণের চরম ফল তারাই পায় । আমি আপাতত মোটরে চড়ে চললেম ইসফাহনে । সকালবেলা মেঘাচ্ছন্ন, কাল বিকেল থেকেই তার আয়োজন । আজ শীত পড়েছে রীতিমত । একঘেয়ে শূন্যপ্রায় প্রান্তরে আসন্ন বৃষ্টির ছায়া বিতীর্ণ। দিগন্ত বেষ্টন করে যে গিরিমালা, নীলাভ অস্পষ্টতায় সে অবগুষ্ঠিত । ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলেছি। অন্তহীন, আলোর-চিহ্ন-হীন মাঠের মধ্যে বিসৰ্পিত পথ দিয়ে । কিন্তু মানুষ কোথায় । চাবী কেন হাল লাঙল নিয়ে মাঠে আসে না । হাটের দিন হাট করতে যায় না কেউ ; ফসলের খেত নিড়েবার বুঝি দরকার নেই ? দূরে দূরে বন্ধুকধারী পাহারাওয়ালা দাড়িয়ে, তার থেকে আন্দাজ করা যায় ঐ দিগন্তের বাইরে অদৃশ্য নেপথ্যে কোথাও মানুষের নানান্বন্ত্ববিঘটিত সংসারযাত্রা চলেছে। মাঠে কোথাও-বাঁ ফসল, কোথাও-বাঁ বহুদূর ধরে আগাছা, তাতে উর্ধপুচ্ছ সাদা সাদা ফুলের স্তবক। মাঝে মাঝে ছোটাে নদী, কিন্তু তাকে আঁকড়ে নেই গ্রাম। মেয়েরা জল তোলে না, কাপড় কাচে না, স্নান করে না, গোরুবাছুর জল খায় না ; নির্জন পাহাড়ের তলা দিয়ে চলে, যেন সন্তানহীন বিধবার মতো। অনেকক্ষণ পরে বিনা ভূমিকায় এসে পড়ে মাটির পাচিলেঘেরা গ্রাম, একটু পরেই আর তার অনুবৃত্তি নেই। আবার সেই শূন্য মাঠ, আর মাঠের শেষে ঘিরে আছে পাহাড় ।