পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৬৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পারস্যে 98) সবুজ রঙের দুর্ভিক্ষ, তাই চোখের ক্ষুধা মেটাবার এই আয়োজন । বাবর ভারতবর্ষে বাগানের অভাব দেখে অবজ্ঞা প্রকাশ করেছিলেন । তিনি এসেছিলেন মরুপ্রদেশ থেকে, বাগান তাদের পক্ষে শুধু কেবল বিলাসের জিনিস ছিল না, ছিল অত্যাবশ্যক। তাকে বহুসাধনায় পেতে হয়েছে বলে এত ভালোবাসা । বাংলাদেশের মেয়েরা পশ্চিমের মেয়েদের মতো পরিবার শাড়িতে রঙের সাধনা করে না, চারি দিকেই রঙ এত সুলভ। বাংলায় দোলাই-কঁথায় রঙ ফলে ওঠে নি, লতাপাতার রঙিন ছাপওয়াল ছিট পশ্চিমে । বাড়ির দেয়ালে রঙ লাগায় মারোয়াড়ি, বাঙালি লাগায় না । আজ সকালবেলায় স্নান করবার অবকাশ রইল না। একে একে এখানকার মূনিসিপালিটি, মিলিটারি-বিভাগ, শিক্ষাবিভাগ, বণিকসভা আমাকে সাদর সম্ভাষণ জানাতে এসেছিলেন। বেলা তিনটের পর শহর পরিক্রমণে বোরলাম। ইস্পাহানের একটি বিশেষত্ব আছে, সে আমার চোখে সুন্দর লাগিল । মানুষের বাসা প্রকৃতিকে একঘরে করে রাখেনি, গাছের প্রতি তার ঘনিষ্ঠ আনন্দ শহরের সর্বত্রই প্ৰকাশমান । সারিবাধা গাছের তলা দিয়ে দিয়ে জলের ধারা চলেছে, সে যেন মানুষেরই দরদের প্রবাহ । গাছপালার সঙ্গে নিবিড় মিলনে নগরটিকে সুস্থ প্রকৃতিস্থা বলে চোখে ঠেকে। সাধারণত উড়ো-জাহাজে চড়ে শহরগুলোকে দেখলে যেন মনে হয়। পৃথিবীর চর্মরোগ । মানুষের নিজের হাতের আশ্চর্য কীর্তি আছে এই শহরের মাঝখানে, একটি বৃহৎ ময়দান ঘিরে । এর নাম ময়দান-ই-শ্যা অর্থাৎ বাদশাহের ময়দান । এখানে এক কালে বাদশাহের পোলো খেলবার জায়গা ছিল । এই চত্বরের দক্ষিণ সীমানার মাঝখানে দাড়িয়ে আছে মসজিদ-ই-শা। প্ৰথমা শা আকবাসের আমলে এর নির্মাণ আরম্ভ, আর তার পুত্র দ্বিতীয় শা আকবাসের সময়ে তার সমাপ্তি। এখন এখানে ভজনার কাজ হয় না । বর্তমান বাদশাহদের আমলে বহুকালের ধুলো ধুয়ে একে সাফ করা হচ্ছে । এর স্থাপত্য একাধারে সমুচ্চ গভীর ও সযত্বসুন্দর, এর কারুকার্য বলিষ্ঠ শক্তির সুকুমার সুনিপুণ অধ্যবসায়ের ফল। এর পার্শ্ববতী আর-একটি মসজিদ মাদ্রাসে-ই-চাহার বাগে প্রবেশ করলুম। এক দিকে উছিত বিপুলতায় এ সুমহান, যেন স্তবমন্ত্র, আর-এক দিকে সমস্ত ভিত্তিকে খচিত করে বর্ণসংগতির বিচিত্ৰতায় রমণীয়, যেন গীতিকাব্য । ভিতরে একটি প্রাঙ্গণ, সেখানে প্রাচীন চেনার গাছ এবং তুত, দক্ষিণ ধারে অত্যুচ্চগুম্বজওয়ালা সুপ্ৰশন্ত ভজনা গৃহ । যে টালিতে ভিত্তি মণ্ডিত তার কোথাও কোথাও চিকণ পাতলা বর্ণপ্রলেপ ক্ষয়প্রাপ্ত, কোথাও-বা। পরবর্তীকালে টালি বদল করতে হয়েছে, কিন্তু নূতন যোজনােটা খাপ খায় নি। আগেকার কালের সেই আশ্চর্য নীল রঙের প্রলেপ এ কালে অসম্ভব। এ ভজনালয়ের যে ভাবটি মনকে অধিকার করে সে হচ্ছে এর সুনির্মল সমুদার গাষ্ঠীৰ্য । অনাদর-অপরিচ্ছন্নতার চিহ্ন কোথাও নেই। সর্বত্র একটি সসন্ত্ৰম সম্মান যথার্থ শুচিত রক্ষা করে বিরাজ করছে । এই মসজিদের প্রাঙ্গণে যাদের দেখলেম তাদের মোল্লার বেশ । নিরুৎসুক দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকিয়ে দেখলে, হয়তো মনে মনে প্ৰসন্ন হয় নি । শুনলুম। আর দশ বছর আগে এখানে আমাদের প্ৰবেশ সম্ভবপর হত না । শুনে আমি যে বিস্মিত হব সে রাস্তা আমার নেই। কারণ, আর বিশ বছর পরেও পুরীতে জগন্নাথের মন্দিরে আমার মতো কোনো ব্রাত্য যে প্রবেশ করতে পারবে সে আশা করা विgबना । শহরের মাঝখান দিয়ে বালুশয্যার মধ্যে বিভক্ত-ধারা একটি নদী চলে গেছে। তার নাম জই আন্দোরু, তুর্থাৎ জন্মদায়িনী । এই নদীর তলদেশে যেখানে খোড়া যায়। সেখান থেকেই উৎস ওঠে, তাই এর এই নাম- উৎসজননী । কলকাতার ধারে গঙ্গা যেরকম ক্লিষ্ট কলুবিত শৃঙ্খলজৰ্জর, এ সেরকম নয় । গঙ্গাকে কলকাতা কিংকরী করেছে, সখী করে নি, তাই অবমানিত নদী হারিয়েছে তার রূপলাবণ্য। এখানকার এই পুরবাসিনী নদী গঙ্গার তুলনায় অগভীর ও অপ্ৰশন্ত বটে, কিন্তু এর সুন্থ সৌন্দৰ্য নগরের হৃদয়ের মধ্যে দিয়ে চলেছে আনন্দ বহন করে । এই নদীর উপরকার একটি ব্রিজ দেখতে এলুম, তার নাম আলিবাদী-খার পুল। আলিবাদী