পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৬৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Voo রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী শা-আকবাসের সেনাপতি, বাদশার হুকুমে এই পুল তৈরি করেছিলেন । পৃথিবীতে আধুনিক ও প্রাচীন অনেক ব্রিজ আছে, তার মধ্যে এই কীর্তিটি অসাধারণ। বহুখিলানওয়ালা তিন-তলা এই পুল ; শুধু এটার উপর দিয়ে পথিক পার হয়ে যাবে বলে এ তৈরি হয় নি- অর্থাৎ এ শুধু উপলক্ষ নয়, এও স্বয়ং লক্ষ্য । এ সেই দিলাদরিয়া যুগের রচনা যা আপনার কাজের তাড়াতেও আপন মর্যাদা ভুলত না । ব্রিজ পার হয়ে গেলুম এখানকার আর্মানি গির্জায়। গির্জার বাহিরে ও অঙ্গনে ভিড় জমেছে। ভিতরে গেলেম । প্রাচীন গির্জা । উপাসনা-ঘরের দেয়াল ও ছাদ চিত্রিত, অলংকৃত । দেয়ালের নীচের দিকটায় সুন্দর পারসিক টালির কাজ, বাকি অংশটায় বাইবেল-বর্ণিত পৌরাণিক ছবি আঁকা । জনশ্রুতি এই যে, কোনো ইটালিয়ন চিত্রকর ভ্ৰমণ করতে এসে এই ছবিগুলি ঐকেছিলেন । তিনশো বছর হয়ে গেল, শা-আকবাস রুশিয়া থেকে বহু সহস্র আর্মানি আনিয়ে ইস্পাহানে বাস করান। তারা কারিগর ছিল ভালো । তখনকার দেশবিজয়ী রাজারা শিল্পদ্রব্যের সঙ্গে শিল্পীদেরও লুঠ করতে ছাড়তেন না । শা-আকবাসের মৃত্যুর পর তাদের উপর উৎপাত আরম্ভ হল । অবশেষে নাদির শাহের আমলে উপদ্রব এত অসহ্য হয়ে উঠল যে টিকতে পারলে না । সেই সময়েই আর্মানিরা প্ৰথম ভারতবর্ষে পালিয়ে আসে । বর্তমান বাদশাহের আমলে তাদের কোনো দুঃখ নেই। কিন্তু সে কালে কারুনৈপুণ্য সম্বন্ধে তাদের যে খ্যাতি ছিল এখন তার কিছু বাকি আছে বলে বোধ হল না । বাজারের মধ্য দিয়ে বাড়ি ফিরলুম। আজ কী-একটা পরবে দোকানের দরজা সব বন্ধ । এখানকার সুদীর্ঘ চিনার-বীথিকায় গিয়ে পড়লুম। বাদশাহের আমলে এই রাস্তার মাঝখান দিয়ে টালি-বাধানো নালায় জল বইত, মাঝে মাঝে খেলত ফোয়ারা, আর ছিল ফুলের কেয়ারি । দরকারের জিনিসকে করেছিল আদরের জিনিস ; পথেরও ছিল আমন্ত্রণ, আতিথ্য । ইস্পাহানের ময়দানের চারি দিকে যে-সব অত্যাশ্চর্য মসজিদ দেখে এসেছি তার চিন্তা মনের মধ্যে ঘুরছে । এই রচনা যে যুগের সে বহুদূরের, শুধু কালের পরিমাপে নয়, মানুষের মনের পরিমাপে । তখন এক-একজন শক্তিশালী লোক ছিলেন সর্বসাধারণের প্রতিনিধি । ভূতলসৃষ্টির আদিকালে ভূমিকম্পের বেগে যেমন বড়ো পাহাড় উঠে পড়েছিল তেমনি । এই পাহাড়কে সংস্কৃত ভাষায় বলে ভূধর, অর্থাৎ সমস্ত ভূমিকে এই এক-একটা উচ্চচুড়া দৃঢ় ক'রে ধারণ করে এইরকম বিশ্বাস । তেমনি মানবসমাজের আদিকালে এক-একজন গণপতি সমস্ত মানুষের বল আপনার মধ্যে সংহত করে জনসাধারণকে নিজের মধ্যে প্ৰকাশ করেছেন । তাতে সর্বসাধারণ আপনার সার্থকতা দেখে আনন্দ পেত । তারা একলাই যেমন সর্বজনের দায়িত্ব গ্রহণ করতেন তেমনি তাদেরই মধ্যে সর্বজনের গৌরব, বহুজনের কাছে বহুকালের কাছে তাদের জবাবদিহি । তাদের কীর্তিতে কোনো অংশে দারিদ্র্য থাকলে সেই আমর্যাদা বহুলোকের, বহুকালের । এইজন্যে তখনকার মহৎ ব্যক্তির কীর্তিতে দুঃসাধ্যসাধন হয়েছে। সেই কীর্তি এক দিকে যেমন আপনি স্বাতন্ত্র্যে বড়ো তেমনি সর্বজনীনতায় । মানুষ আপন প্রকাশে বৃহতের যে কল্পনা করতে ভালোবাসে তাকে আকার দেওয়া সাধারণ লোকের সাধ্যের মধ্যে নয়। এইজন্য তাকে উপযুক্ত আকারে প্রকাশ দেবার ভার ছিল নরোত্তমের, নরপতির । রাজা বাস করতেন রাজপ্রাসাদে, কিন্তু বস্তুত সে প্রাসাদ সমস্ত প্ৰজার- রাজার মধ্য দিয়ে সমস্ত প্ৰজা সেই প্রাসাদের অধিকারী । এইজন্যে রাজাকে অবলম্বন করে প্রাচীনকালে মহাকায় শিল্পীসৃষ্টি সম্ভবপর হয়েছিল। পার্সিপোলিসে দরিয়ুস রাজার রাজগহে যে ভগ্নাবশেষ দেখা যায় সেটা দেখে মনে হয়, কোনো একজন ব্যক্তিবিশেষের ব্যবহারের পক্ষে সে নিতান্ত অসংগত । বস্তুত একটা বৃহৎ যুগ। তার মধ্যে বাসা বেঁধেছিল- সে যুগে সমস্ত মানুষ এক-একটি মানুষে অভিব্যক্ত । পর্সিপোলিসের যে কীর্তি আজ ভেঙে পড়েছে তাতে প্ৰকাশ পায়, সেই যুগ গেছে ভেঙে। এরকম কীর্তির আর পুনরাবর্তন অসম্ভব । যে প্রান্তরে আজকের যুগ চাষ করছে, পশু চরাচ্ছে, যে পথ দিয়ে আজকের যুগ। তার পণ্য বহন করে চলেছে, সেই প্ৰান্তরের ধারে, সেই পথের প্রান্তে এই অতিকায় স্তম্ভগুলো আপন সার্থকতা হারিয়ে দাঁড়িয়ে আছে । তবু মনে হয়, দৈবাৎ যদি না ভেঙে যেত। তবু আজকেকার সংসারের মাঝখানে থাকতে পেত না ।