পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৭০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পারস্যে VGS যেমন আছে। অজন্তার গুহা, আছে। তবু নেই। ঐ ভাঙা থামগুলো সেকালের একটা সংকেতমাত্র নিয়ে আছে, ব্যতিব্যস্ত বর্তমানকে পথ ছেড়ে দিয়ে । সেই সংকেতের সমস্ত সুমহৎ তাৎপর্য অতীতের দিকে । নীচের রাস্তায় ধুলো উড়িয়ে ইতরের মতো গর্জন করে চলেছে মোটর-রিথ । তাকেও অবজ্ঞা করা যায় না, তার মধ্যেও মানবমহিমা আছে। কিন্তু এরা দুই পৃথক জাত, সগোত্র নয়। একটাতে আছে সর্বজনের সুযোগ, আর-একটাতে আছে সর্বজনের আত্মশ্লাঘা । এই প্লাঘার প্রকাশে আমরা দেখতে পেলুম সেই অতীতকালের মানুষ কেমন করে প্রবল ব্যক্তিস্বরাপের মধ্যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নিজেকে মিলিয়ে দিয়ে এক-একটি বিরাট আকারে আপনাকে দেখতে চেয়েছে। প্রয়োজনের পরিমাপে সে আকারের মূল্য নয়, প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশিকেই বলে ঐশ্বৰ্য- সেই ঐশ্বৰ্যকে তার অসামান্যরূপে মানুষ দেখতে পায় না, যদি কোনো প্রবল শক্তিশালীর মধ্যে আপন শক্তিকে উৎসৃষ্টি করে এই ঐশ্বৰ্যকে ব্যক্তি করা না হয় । নিজের নিজের ক্ষুদ্র শক্তি ক্ষুদ্র প্রয়োজনের মধ্যে প্রতিদিন খরচ হয়ে যায়, সেই দিনযাত্রা প্রয়োজনের-অতীত মাহাত্ম্যকে বাধতে পারে না । সেই ঐশ্বৰ্য-যুগ, যে ঐশ্বৰ্য আবশ্যককে অবজ্ঞা করতে পারত, এখন চলে গেছে । তার সাজসজা সমারোহভার এখনকার কাল বহন করতে অস্বীকার করে । অতএব সেই যুগের কীর্তি এখনকার চলতি কালকে যদি চেপে বসে। তবে এই কালের অভিব্যক্তির পথকে বাধাগ্রান্ত করবে । মানুষের প্রতিভা নবনবোন্মেষে, কোনো একটা মাত্র আবির্ভাবকেই দীর্ঘায়িত করার দ্বারা নয়, সে আবির্ভাব যতই সুন্দর যতই মহৎ হােক । মাদুরার মন্দির, ইস্পাহানের মসজিদ প্রাচীন কালের অস্তিত্বের দলিল- এখনকার কালকে যদি সে দখল করে তবে তাকে জবরদখল বলব । তারা যে সজীব নয়। তার প্রমাণ এই যে, আপনি ধারাকে আর তারা চালনা করতে পারছে না । বাইরে থেকে তাদের হয়তো নকল করা যেতে পারে, কিন্তু নিজের ভিতরে তাদের নূতন সৃষ্টির আবেগ ফুরিয়ে ፲ና፲Oቒ | এদের কৈফিয়ত এই যে, এরা যে ধর্মের বাহন এখনো সে টিকে আছে । কিন্তু আজকের দিনে কোনো সাম্প্রদায়িক ধর্ম ধর্মের বিশুদ্ধ প্ৰাণতত্ত্ব নিয়ে টিকে নেই । যে-সমস্ত ইটকাঠ নিয়ে সেই-সব সম্প্রদায়কে কালে কালে ঠেকো দিয়ে দিয়ে খাড়া করে রাখা হয়েছে তারা সম্পূর্ণ অন্য কালের আচার বিচার প্রথা বিশ্বাস। জনশ্রুতি । তাদের অনুষ্ঠান, তাদের অনুশাসন এক কালের ইতিহাসকে অন্য কালের উপর চাপা দিয়ে তাকে পিছিয়ে রাখে । সাম্প্রদায়িক ধর্ম জিনিসটাই সাবেক কালের জিনিস । পুরাকালের কোনো একটা বাধা মত ও অনুষ্ঠানকে সকল কালেই সকলে মিলে মানতে হবে, এই হচ্ছে সম্প্রদায়ের শাসন । বস্তুত এতকাল রাজশক্তি ও পৌরোহিতশক্তি জুড়ি মিলিয়ে চলেছে। উভয়েই জনসাধারণের আত্মশাসনভার, চিন্তার ভার, পূজার ভার, তাদের স্বাধীন শক্তি থেকে হরণ করে অন্যত্র এক জায়গায় সংহত করে রেখেছে। ব্যক্তিবিশেষ যদি নিজের চিত্তশক্তির প্রবর্তনায় স্বাতম্যের চেষ্টা করে তবে সেটাকে বিদ্রোহের কোঠায় ফেলে তাকে প্রাণান্তকর কঠোরতার সঙ্গে শাসন করে এসেছে । কিন্তু রা নৈতিক শক্তি ক্রমে এক কেন্দ্রের হাত থেকে সাধারণের পরিধিতে ব্যাপ্ত হয়ে পড়েছে, অথচ চিরকালের মতো বাধা মতের ধর্মসম্প্রদায় আজকের দিনে সকলেরই চিত্তকে এক শাসনের দ্বারা, ভয়ের দ্বারা, লোভের দ্বারা, মোহের দ্বারা অভিভূত করে স্থাবর করে রেখে দেবে- এ আর চলবে না। এই কারণে এইরকম সাম্প্রদায়িক ধর্মের যা-কিছু প্ৰতীক তাকে আজ জোর করে রক্ষা করতে গেলে মানুষ নিজের মনের জোর খোওয়াবে ; বয়স উত্তীর্ণ হলেও যে ছেলে মায়ের কোল আঁকড়ে মেয়েলি স্বভাব নিয়ে থাকে তারই মতো অপদার্থ হয়ে থাকবে । প্রাচীন কীর্তি টিকে থাকবে না। এমন কথা বলি নে । থােক- কিন্তু সে কেবল স্মৃতির বাহনরাপে, ব্যবহারের ক্ষেত্ররূপে নয়। যেমন আছে স্ক্যান্ডিনেবীয় সাগা- তাকে কাব্য বলে স্বীকার করব, ধর্মগ্রন্থ বলে ব্যবহার করব না । যেমন আছে প্যারাডাইস লস্ট- তাকে ভোগ করবার জন্যে, মানবার জন্যে নয় । যুরোপে পুরাতন ক্যাথিড্রাল আছে অনেক, কিন্তু মানুষের মধ্যযুগীয় যে ধর্মবোধ থেকে তার উদ্ভব S S 8 SR