পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৭৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

MeNeO রবীন্দ্র-রচনাবলী পথিকের মতো পথ চলতে চলতে আমি আজ এখানকার ছবি দেখতে দেখতে চলেছি। সম্পূর্ণ করে কিছু দেখবার সময় নেই। আমার মনে যে ধারণাগুলো হচ্ছে সে দ্রুত আভাসের ধারণা। বিচার করে উপলব্ধি নয়, কেবলমাত্র মানসিক হাত বুলিয়ে যাবার অনুভূতি । এই যেমন, সেদিন একজন মানুষের সঙ্গে হঠাৎ অল্পক্ষণের আলাপ হল । একটা ছায়াছবি মনে রয়ে গেল, সেটা নিমেষকালের আলোতে তোলা। তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞানবিৎ গাণিতিক। সৌম্য তার মূর্তি, মুখে স্বচ্ছাচিত্তের প্রকাশ । ঐার বেশ মোল্লার, কিন্তু ঐরি বুদ্ধি সংস্কারমোহমুক্ত, ইনি আধুনিক অথচ চিরকালের পারসিক । ক্ষণকালের দেখাতেই এই মানুষের মধ্যে আমি পারস্যের আত্মসমাহিত স্বপ্রকৃতিস্থ মূর্তি দেখলুম, যে পারস্যে একদা আবিসেন্না ছিলেন বিজ্ঞান ও তত্ত্বজ্ঞানের অদ্বিতীয় সাধক এবং জালালউদ্দিন গভীরতম আত্মোপলব্ধিকে সরসতম সংগীতে প্রবাহিত করেছিলেন । অধ্যাপক ফেরুঘির কথা পূর্বেই বলেছি। তিনিও আমার মনে একটি চিত্র ঐকে দিয়েছেন, সে চিত্ৰও চিত্তবান পারসিকের । অর্থাৎ ঐার স্বদেশীয় স্বভাব বিদেশীর কাছেও সহজে প্ৰকাশমান । যে মানুষ সংকীর্ণভাবে একান্তভাবে স্বাদেশিকতার মধ্যে বদ্ধ, তিনি স্বদেশকে প্রকাশ করেন না, কেননা, মূর্তি আপন দেশের মাটিতে গড়া হলেও যে আলো তাকে প্রকাশ করবে। সে আলো যে সার্বভৌমিক । তেহেরান থেকে বিদায় নেবার দিন এল, প্ৰধান মন্ত্রীবর্গ এসে আমাকে বিদায় দিলেন । ܘܶ বেলা আড়াইটার সময় যাত্রা করলুম। তেহেরান থেকে বেরিয়ে প্রথমটা পারস্যের নীরস নির্জন চেহারা আবার দেখা দিল, কিন্তু বেশিক্ষণ নয়। দৃশ্যপরিবর্তন হল । ফসলে সবুজ মাঠ, মাঝে মাঝে তরুসংহতি, যেখানে-সেখানে জলের চঞ্চল ধারা, মেটে ঘরের গ্রাম তেমন বিরল নয় । দিগন্তে বরফের আঙুল-বুলানো গিরিশিখর। সূর্যান্তের সময় কাজবিন শহরে পৌঁছলুম। এখানে একটি হােটেলে আমাদের জায়গা হয়েছে। বাংলাদেশে রেলপথের প্রধান জংশন যেমন আসানসোল, এখানে নানা পথের মোটরের সংগমতীর্থ তেমনি কাজবিন । কাজবিন সাসানীয় কালের শহর, দ্বিতীয় শাপুর -কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত । দ্বিতীয় সাফাবি রাজা তামাম্প এই শহরে তার রাজধানী স্থাপন করেন। দিল্লির পলাতক মোগল বাদশা হুমায়ুন দশবৎসরকাল এখানে তারই আশ্রয়ে ছিলেন । সাফাবি বংশের বিখ্যাত শা আকবাসের সঙ্গে অ্যান্টনি ও রবার্ট শালি -নামক দুই ইংরেজ ভ্রাতার এইখানেই দেখা হয় । জনশ্রুতি এই যে, ঐরাই কামান প্রভৃতি অন্ত্রসহযোগে আধুনিককালীন যুদ্ধবিদ্যায় বাদশাহের সৈন্যদের শিক্ষিত করেন । যাই হােক, বর্তমানে এই ছোটাে শহরটিতে সাবেক কালের রাজধানীর মর্যাদা কিছুই চোখে পড়ে না । سمی" ভোরবেলা ছাড়লুম হামাদানের অভিমুখে । চড়াইপথে চলল আমাদের গাড়ি । দুই ধারে ভূমি সুজলা সুফলা, মাঝে মাঝে বড়ো বড়ো গ্রাম, আঁকাবঁকা নদী, আঙুরের খেত, আফিমের পুষ্পোচ্ছাস । বেলা দুপুরের সময় হামাদানে পৌঁছিয়ে একটি মনোহর বাগানবাড়ির মধ্যে আশ্রয় পাওয়া গেলপপলার-তরুসংঘের ফাকের ভিতর দিয়ে দেখা যাচ্ছে বরফের-আঁচড়-কাটা পাহাড় । তেহেরানে গরম পড়তে আরম্ভ করেছিল, এখানে ঠাণ্ডা । সমুদ্রের উপরিতল থেকে এ শহর ছ-হাজার ফুট উচু। এলভেন্দ পাহাড়ের পাদদেশে এর স্থান। একদা আকেমেনীয় সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল এইখানে । সেই রাজধানীর প্রাচীন নাম ইতিহাসবিখ্যাত একবাতানা, আজ তার ধ্বংসাবশেষ প্ৰায় কিছু বাকি নেই। আহার ও বিশ্রামের পর বিকেলবেলা শহর দেখতে বোরলাম। প্ৰথমে আমাদের নিয়ে গেল ঘন বনের মধ্য দিয়ে গলিপথ বেয়ে একটি পুরোনো বড়ো ইমারতের সামনে । বললে, এর উপরের তলা