পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৮০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

と S পারসো ど থেকে চারি দিকের দৃশ্য অবারিত দেখতে পাওয়া যায় । আমার সঙ্গীরা দেখতে গেলেন, কিন্তু আমার সাহস হল না । গাড়িতে বসে দেখতে লাগলুম একদল লোক এসেছে বনের ধারে চড়িভাতি করতে । মেয়েরাও তার মধ্যে আছে ; তারা কালো চাদরে মোড়া ; কিন্তু দেখছি বাইরে বেরতে রাস্তায় ঘাটে বেড়াতে 'এদের সংকোচ নেই । আজ মহররমের ছুটি, সবাই ছুটি উপভোগ করতে বেরিয়েছে । অল্প কয়েক বছর আগে মহররমের ছুটি রক্তাক্ত হয়ে উঠত, আত্মপীড়নের তীব্রতায় মারা যেত কত লোক । বর্তমান রাজার আমলে ধীরে ধীরে তার তীব্ৰতা কমে আসছে । বনের ভিতর থেকে বেরিয়ে শহরে গেলেম । আজ দোকান বাজার বন্ধ, কিন্তু ছুটির দলের খুব ভিড় । পারস্যে এসে অবধি মানুষ কম দেখা আমাদের অভ্যাস, তাই রাস্তায় এত লোক আমাদের চোখে নতুন লাগল। আরো নতুন লাগল। এই শহরটি । শহরের এমন চেহারা আর-কোথাও দেখি নি । মাঝখান দিয়ে একটি অপ্রশস্ত খামখেয়ালী ঝরনা নানা ভঙ্গিতে কলশব্দে বহমান- কোথাও-বা উপর থেকে নীচে পড়ছে ঝরে, কোথাও-বা তার সমতলী স্রোত রৌদ্রে ঝলমল করছে, ধারে ধারে পাথরের তৃপ, মাঝে মাঝে ছোটাে ছোটাে সঁাকো এপার থেকে ওপারে ; ঝর্নার সঙ্গে পথের আঁকাবঁকা মিল ; মানুষের কাজের সঙ্গে প্রকৃতির গলাগলি ; বাড়ির শামিল উন্মুক্ত প্রাঙ্গণগুলি উপরের থাকে, নীচের থাকে, এ কোণে, ও কোণে । তারই নানা জায়গায় নানা দল বসে গেছে । বাকাচোরা রাস্তায় মোটরগাডি, ঘোড়ার গাডি, এমন-কি, মোটর বাস ভর্তি করে চলেছে সব ছুটি-সম্ভোগীর দল। গাডির ঘোড়াগুলি সুশ্ৰী সুপুষ্ট । এই ছুটির পরিবে মত্ততা কিছুই দেখলুম না, চারি দিকে শান্ত আরামের ছবি এখানকার অরণ্য পর্বত ঝর্নার সঙ্গে মিশে গেছে । গবর্নর কাল শহরের বাইরে বনের মধ্যে বিকেলে আমাদের চায়ে নিমন্ত্রণ করেছিলেন । বা ধারে পাহাড়, ডাইনে ঘন অরণ্যের অন্ধকার ছায়ায় ঝর্না ঝরে পড়ছে । পাহাড়ী পথ বেয়ে বহু চেষ্টায় মোটর গেল । সেই বহুযুগের মেষপালকদের ভেড়া-চডা বনের মধ্যে চা খেয়ে সন্ধ্যাবেলায় বাসায় ফিরে এলুম, হামাদানের যে মূর্তি চিরসজীব, শতাব্দীর পর শতাব্দী সেখানে বুলবুল গান করে আসছে, আলেকজান্ডারের লুঠের বোঝার সঙ্গে সে অন্তর্ধান করে নি, কিন্তু পথের ধারে প্রান্তরের মধ্যে অনাদরে পড়ে আছে একটি পাথরের পিণ্ড, সম্রাটের সিংহদ্বারের সিংহের এই অপভ্ৰংশ । স্নানাহার সেরে দুপুরের পাব হামাদান থেকে রওনা হলুম । যেতে হবে কির্মানশা । তখন ঝোডো হাওয়ায় ধুলো উড়িয়েছে, আকাশে মেঘ ঘনিয়ে এল। চলেছি আসাদাবাদ গিরিপথ দিয়ে । দুই ধারে সবুজ খেত ফসলে ভবা, মাঝে মাঝে বনভূমি জলস্রোতে লালিত । মাঠে ভেড়া চরছে। পাহাড়গুলো কাছে এগিয়ে এসে তাদের শিলাবক্ষপট প্রসারিত করে দাড়িয়ে । থেকে থেকে এক-এক পসিলা বৃষ্টি নেমে ধুলোকে দেয় পরাভূত করে । আমার কেবল মনে পড়ছিল ‘মেঘৈর্মেদূরমম্বরম্বনভূবঃশ্যামাঃ'. তমালক্রমে নয়, কী গাছ ঠিক জানি নে, কিন্তু এই মেঘলা দিনে উপস্থিতমত ওকে তিমালগাছ বলতে দোষ নেই । আমরা যে পথ দিয়ে চলেছি। এরই কাছাকাছি কোনো-এক জায়গায় বিখ্যাত নিহাবিন্দের রণক্ষেত্রে সাসানীয় সাম্রাজা আরবদের হাতে 'লীলা সমাপন করে । সেইদিন বহুকালীন প্ৰাচীন পারসোর ইতিহাসে হঠাৎ সম্পূৰ্ণ নূতন অধ্যায় শুরু হল । অবশেষে আমাদের রাস্তা এসে পড়ল বেহিস্তনে। এখানে শৈলগাত্রে দরিয়ুসের কীর্তিলিপি পারসিক সুসীয় ও ব্যাবিলোনীয় ভাষায় ক্ষোদিত । এই ক্ষোদিত ভাষার উর্ধে দরিয়ুসের মূর্তি। এই মূর্তির সামনে বন্দীবেশে দশজন বিদ্রোহীর প্রতিরূপ । এরা তার সিংহাসন-অধিরোহণে বাধা দিয়েছিল । দরিয়ুসের পূর্ববতী রাজা ক্যাম্বাইসিস (পারসিক উচ্চারণ কাম্ব্যোজ্যিয়) ঈর্ষাবশত গোপনে তার ভ্রাতা স্মদিসকে হত্যা করিয়েছিলেন । যখন তিনি ঈজিপ্ট-অভিযানে তখন তার অনুপস্থিতিকালে সীেমতে বলে এক ব্যক্তি নিজেকে স্মদিস নামে প্রচার করে সিংহাসন দখল করে বসে। ক্যাম্বাইসিস ঈজিপ্ট থেকে ফেরবার পথে মারা যান । যখন আকেমেনীয় বংশের অপর শাখাভূক্ত দরিয়ুস ছদ্মরাজাকে পরাস্তু