পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৮২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পারস্যে &ኃሏኃS) আলেকজান্ডারের আক্রমণে আকেমেনীয় রাজত্বের অবসান হল । পরে যে জাত পারস্যকে দখল করে তাদের বলে পাখীয়া । তারা সম্ভবত শাকজাতীয় ; প্ৰথমে গ্রীকদের প্রভাবে আসে, পরে তারা পারসিক সভ্যতা গ্ৰহণ করে । অবশেষে ২২৬ খৃস্টাব্দে সাসানের পৌত্ৰ আদশির পার্থীয় রাজার হাত থেকে পারস্যকে কেড়ে নিয়ে আর-একবার বিশুদ্ধ পারসিক জাতির সাম্রাজ্য স্থাপন করেন । এদের সময়কার প্রবল সম্রাট ছিলেন শাপুর, তিনিই রোমের সম্রাট ভ্যালেরিয়ানকে পরান্ত ও বন্দী করেন । আকেমেনীয়দের ধর্ম ছিল জরথুস্ত্রীয়, সাসানীয়দের আমলে আর-একবার প্রবল উৎসাহে এই ধর্মকে জাগিয়ে তোলা হয় । ঋজু প্রশস্ত নূতন-তৈরি পথ বেয়ে আসছি। অদূরে সামনে পাহাড়ের গায়ে কির্মনশা শহর দেখা দিল । পথের দুই ধারে ফসলের খেত, আফিমের খেত ফুলে। আচ্ছন্ন, মেঘের আড়াল থেকে অস্তসূর্যরশ্মির আভা পড়ে সদাধেীত গাছের পাতা ঝলমল করছে। শহরে প্রবেশ করলুম। পরিষ্কার রাস্তার দুই ধারে নানাবিধ পণ্যের দোকান। পথের ধুলো মারবার জন্যে ভিস্তিরা মশকে করে জল ছিটাচ্ছে । সুন্দর বাগানের মধ্যে আমাদের বাসা । দ্বারের কাছে দাড়িয়ে ছিলেন। এখানকার গবর্নর। ঘরে নিয়ে গিয়ে চা খাওয়ালেন । এই পরিষ্কার সুসজ্জিত নূতন বাড়িটি আমাদের ব্যবহারের জন্য ছেড়ে দিয়ে গৃহস্বামী চলে গেছেন । SO কির্মানশা থেকে যাত্রা করে বেরলুম। আজ যেতে হবে কাসরিশিরিনে, পারস্যের সীমানার কাছে। তার পরে আসবে কানিকিন, আরব-সীমানার রেলওয়ে স্টেশন । পারসো প্রবেশপথে আমরা তার যে নীরস মূর্তি দেখেছিলুম এখন আর তা নেই। পাহাড়ের রাস্তার দুই ধারে খেত ভরে উঠেছে ফসলে, গ্রামও অপেক্ষাকৃত ঘন ঘন, চাষীরা চাষ করছে। এ দৃশ্যও চোখে পড়ল, তা ছাড়া এই প্রথম গোরু চরাতে দেখলুম। ঘণ্টাদুয়েক পরে সাহাবাদে পৌঁছলুম। এখানে রাজার একটি প্রাসাদ নতুন তৈরি হয়েছে, গবর্নর সেখানে গাছের ছায়ায় বসিয়ে চা খাওয়ালেন, সঙ্গে চললেন, কেরন্দনামক জায়গায় মধ্যাহ্নভোজন করিয়ে আমাদের বিদায় দেবার জন্যে । বড়ো সুন্দর এই গ্রামের চেহারাটি । তরুচ্ছায়ানিবিড় পাহাড়ের কোলে আশ্রিত লোকালয়, ঝর্না ঝরে পড়ছে এদিক-ওদিক দিয়ে, পাথর ডিঙিয়ে । গ্রামের দোকানগুলির মাঝখােন দিয়ে উচুনিচু আঁকাবঁকা পথ, কৌতুহলী জনতা জমেছে। তার পরের থেকে ধরণীর ক্রমেই সেই আবার শুষ্ক নৈরাশোর মূর্তি। আমরা পারস্যের উচ্চভূমি থেকে নেমে চলেছি। সকলেই ভয় দেখিয়েছিলেন। এখান থেকে আমরা অত্যন্ত গরম পাব । তার কোনো লক্ষণ দেখলুম না । হাওয়াটা আমাদের দেশের মাঘ মাসের মতো। পারস্যের শেষ সীমানায় যখন পীেছলুম দেখা গেল বোগদাদ থেকে অনেকে এসেছেন আমাদের অভ্যর্থনা করবার জন্যে। কেউ কেউ রাজকর্মচারী, কেউ-বা খবরের কাগজের সম্পাদক, অনেকে আছেন সাহিত্যিক, তা ছাড়া প্রবাসী ভারতীয় । এঁরা কেউ কেউ ইংরেজি জানেন । একজন আছেন যিনি নায়র্কে আমার বক্তৃতা শুনেছেন। সেখানে শিক্ষাতত্ত্ব অধ্যয়ন শেষ করে ইনি এখানকার শিক্ষাবিভাগের কাজে নিযুক্ত। স্টেশনের ভোজনশালায় চা খেতে বসলুম। একজন বললেন, যারা এখানে আপনাকে অভ্যর্থনা করতে এসেছেন তাদের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায়ের লোক আছেন । “আমরা সকলেই এক। ভারতীয় মুসলমানেরা ধর্মের নামে কেন যে এমন বিরোধ সৃষ্টি করছে আমরা একেবারেই বুঝতে পারি নে।” ভারতীয়েরাও বলেন, “এখানকার মুসলমানদের সঙ্গে আমাদের হৃদ্যতার লেশমাত্র অভাব নেই।’ দেখা যাচ্ছে ঈজিস্টে তুরুস্কে ইরাকে পারস্যে সর্বত্র ধর্ম মনুষ্যত্বকে পথ ছেড়ে দিচ্ছে। কেবল ভারতবর্ষেই চলবার পথের মাঝখানে ঘন হয়ে কাটগাছ উঠে পড়ে, হিন্দুর সীমানায় মুসলমানের সীমানায় । এ কি পরাধীনতার মরুদৈন্যে লালিত ঈর্ষাবুদ্ধি, এ কি ভারতবর্ষের অনাৰ্যচিত্তাজাত বুদ্ধিহীনতা ।