পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৮৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VVV রবীন্দ্র-রচনাবলী অভিবাদন করেছি। বর্তমান এশিয়ায় ধারা প্রবল শক্তিতে নুতন যুগের প্রবর্তন করেছেন তাদের দুজনকেই দেখলুম। অল্পকালের ব্যবধানে। দুজনেরই মধ্যে স্বভাবের একটি মিল দেখা গেল- উভয়েই আড়ম্বরহীন স্বচ্ছ সরলতার মধ্যে সুস্পষ্টভাবে প্রকাশমান । Ο Ο এখান থেকে বিদায় হয়ে গেলেম এখানকার ছাত্রীদের নিমন্ত্রণসভায় । সংকীর্ণ সুদীর্ঘ আঁকাবঁকা গলি । পুরাতন বাড়ি দুই ধারে সার বেঁধে উঠেছে, কিন্তু তার ভিতরকার লোকযাত্রা বাইরে থেকে কিছুই দেখতে পাওয়া যায় না। নিমন্ত্রণ গৃহের প্রাঙ্গণে সব মেয়েরা বসেছে। এক ধারে কয়েকটি মেয়ে আলাদা স্থান নিয়েছেন, তারা কালো কাপড়ে সমবৃত, কিন্তু মুখ ঢাকা নয়। বাকি সবাই বিলাতি পোশাক পরা, স্তব্ধ শান্ত হয়ে থাকবার চেষ্টামাত্র নেই, হাসিগল্পে সভা মুখরিত। প্রাঙ্গণের সম্মুখপ্রান্ত আমাদের দেশের চণ্ডীমণ্ডপের মতো । তারই রোয়াকে আমার চৌকি পড়েছে। অনুরোধে পড়ে কিছু আমাকে বলতে হল ; বলা হলেই কয়েকজন মেয়ে এসে আমাকে ফরমাশ করলেন আমার কাব্য আবৃত্তি করতে । আগের দিনে ঐরা আবৃত্তি শুনেছিলেন । নিজের লেখা কিছু তো মনে পড়ে না। অনেক চেষ্টা করে ‘খাচার পাখি ছিল সোনার খাচাটিতে’ কবিতার প্রথম শ্লোক পড়ে গেলেম, একটা জায়গায় ঠেকে যেতেই অর্থহীন শব্দ দিয়ে ছন্দ পূরণ করে দিলুম। তার পর সন্ধ্যাবেলায় ভোজনের নিমন্ত্রণ , শিক্ষাবিভাগের লোকেরা আয়োজন করেছেন । নদীর ধারের দিকে প্ৰকাণ্ড একটা ছাদ, সেখানে আলোকমালার নীচে বসে গেছেন অনেক লোক । আমাদের সেই বৃদ্ধ কবিও আমার কাছেই ছিলেন । আহারের পর আমার অভিনন্দন সারা হলে আমাকে কিছু বলতে হল, কেননা শিক্ষা সম্বন্ধে আমার কী মত ঐরা শুনতে চেয়েছিলেন । শ্রান্তি ঘনীভূত হয়ে আসছে । আমার পক্ষে নড়েচড়ে দেখে শুনে বেড়ানো অসম্ভব হয়ে এল। কথা ছিল সকালে টেসিফোনের (Ctesiphon) ভগ্নাবশেষ দেখতে যেতে হবে । আমি ছাড়া আমার দলের বাকি সবাই দেখতে গেলেন । একদা এই শহরের গৌরব ছিল অসামান্য । পার্থিয়ানেরা এর পত্তন করে । পারস্যে অনেকদিন পর্যন্ত এদের রাজত্ব ছিল । রোমকের বার বার এদের হাতে পরান্ত হয়েছে । পর্বেই বলেছি পাখীয়েরা খাটি পারসিক ছিল না । তারা তুর্ক ছিল বলে অনুমান করা হয়, শিক্ষাদীক্ষা অনেকটা পেয়েছিল গ্ৰীকদের কাছ থেকে } ২২৮ খৃস্টাব্দে আর্দাশির পাখীয়দের জয় করে আবার পারস্যকে পারসিক শাসন ও ধর্মের অধীনে এক করে তোলেন । ইনিই সাসানীয় বংশের প্রথম রাজা । তার পরে বার বার রোমানদের উপদ্রব এবং সবশেষে আরবদের আক্রমণ এই শহরকে অভিভূত করেছিল ! জায়গাটা অস্বাস্থ্যকর বলে আরবেরা এখান থেকে সমস্ত মালমসলা সরিয়ে বোগদাদে রাজধানী স্থাপন করে- টেসিাফোন ধূলোয় গেল মিলিয়ে, বাকি রইল বৃহৎ প্রাসাদের একটুখানি খিলান । এই প্রাসাদ প্রথম খসরুর আদেশে নির্মিত হয় সাসানীয় যুগের মহাকায় স্থাপত্যশিল্পের একটি অতি আশ্চর্য দুষ্টান্তরূপে । সন্ধ্যাবেলায় রাজার ওখানে আহারের নিমন্ত্রণ। ঐশ্বৰ্যগৌরব প্রমাণ করবার জন্যে কোথাও লেশমাত্র চেষ্টা নেই। রাজার এই অনাড়ম্বর গাতীৰ্যে আমার চিত্তকে সব চেয়ে আকর্ষণ করে । পারিষদবৰ্গ যারা একত্রে আহার করছিলেন হাস্যালাপে তাদের সকলের সঙ্গে ঐর অতি সহজ সম্বন্ধ । আমাদের দেশের সাধারণ লােকেরাও বিশেষ ভােজে আহারের পরিমাণে ও আয়ােজনে নির্বোধের মতো যে অতিবাহুল্য করে থাকে রাজার ভোজে তা দেখলুম না। লম্বা টেবিলের উপর সাদা চাদর পাতা। বিরলভাবে কয়েকটি ফুলের তোড়া আছে, তা ছাড়া সাজসজ্জার চমক নেই একটুও । এতে আতিথ্যের যথার্থ আরাম পাওয়া যায় } বউমা রানীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন- ভদ্রঘরের গৃহিণীর মতো আড়ম্বরহীন সরল অমায়িক ব্যবহার, নিজেকে রানী বলে প্ৰমাণ করবার প্রয়াসমাত্র নেই । আজ একজন বেদুয়িন দলপতির তাবুতে আমার নিমন্ত্রণ আছে। প্রথমটা ভাবলুম পারব না,