পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৮৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রবীন্দ্র-রচনাবলী তার পরে বাইরে এসে যুদ্ধের নােচ দেখলুম। লাঠি চুরি বন্দুক তলোয়ার নিয়ে আস্ফালন করতে করতে, চিৎকার করতে করতে, চক্রাকারে ঘুরতে ঘুরতে, তাদের মাতুনি- ও দিকে অন্তঃপুরের দ্বার থেকে মেয়েরা দিচ্ছে তাদের উৎসাহ । বেলা চারটি পেরিয়ে গেল, আমরা ফেরবার পথে গাড়িতে উঠলুম, সঙ্গে চললেন আমাদের নিমন্ত্রণকর্তা । এরা মরুর সন্তান, কঠিন এই জাত, জীবনমৃত্যুর দ্বন্ত্ব নিয়ে এদের নিত্য ব্যবহার । এরা কারও কাছে প্রশ্ৰয়ের প্রত্যাশা রাখে না, কেননা পৃথিবী এদের প্রশ্ৰয় দেয় নি। জীববিজ্ঞানে প্রকৃতি-কর্তৃক বাছাইয়ের কথা বলে ; জীবনের সমস্যা সুকঠোর করে দিয়ে এদেরই মাঝে। যথার্থ কড়া বাছাই হয়ে গেছে, দুর্বলেরা বাদ পড়ে যারা নিতান্ত টিকে গেল এরা সেই জাত। মরণ এদের বাজিয়ে নিয়েছে। এদের যে এক-একটি দল তারা অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ, এদের মাতৃভূমির কোলের পরিসর ছোটাে ; নিত্য বিপদে বেষ্টিত জীবনের স্বল্প দান এরা সকলে মিলে ভাগ করে ভোগ করে । এক বড়ো থালে এদের সকলের অন্ন, তার মধ্যে শৌখিন রুচির স্থান নেই ; তারা পরস্পরের মোটা রুটি অংশ করে নিয়েছে, পরস্পরের জন্যে প্ৰাণ দেবার দাবি এই এক রুটি ভাঙার মধ্যেই । বাংলাদেশের নদীবাহুবেষ্টিত সন্তান আমি, এদের মাঝখানে বসে খাচ্ছিলুম। আর ভাবছিলুম, সম্পূর্ণ আলাদা ছাচে তৈরি মানুষ আমরা উভয়ে । তবুও মনুষ্যত্বের গভীরতর বাণীর যে ভাষা সে ভাষায় আমাদের সকলেরই মন সায় দায় । তাই এই অশিক্ষিত বেদুয়িন-দলপতি যখন বললেন “আমাদের আদিগুরু বলেছেন যার বাক্যে ও ব্যবহারে মানুষের বিপদের কোনো আশঙ্কা নেই সেই যথার্থ মুসলমান, তখন সে কথা মনকে চমকিয়ে দিলে। তিনি বললেন, ভারতবর্ষে হিন্দু-মুসলমানে যে বিরোধ চলছে এ পাপের মূল রয়েছে সেখানকার শিক্ষিত লোকদের মনে । এখানে অল্পকাল পূর্বে ভারতবর্ষ থেকে কোনো-কোনো শিক্ষিত মুসলমান গিয়ে ইসলামের নামে হিংস্ৰ-ভেদবুদ্ধি প্রচার করবার চেষ্টা করেছিলেন ; তিনি বললেন, আমি তাদের সত্যতায় বিশ্বাস করি নে, তাই তাদের ভোজের নিমন্ত্রণে যেতে অস্বীকার করেছিলেম, অন্তত আরবদেশে তারা শ্ৰদ্ধা পান নি। আমি ঐকে বললেম, একদিন কবিতায় লিখেছি "ইহার চেয়ে হতেম যদি আরব বেদুয়িন- আজ আমার হৃদয় বেদুয়িন-হৃদয়ের অত্যন্ত কাছে এসেছে, যথার্থই আমি তাদের সঙ্গে এক অন্ন খেয়েছি। অন্তরের মধ্যে । তার পরে যখন আমাদের মোটর চলল, দুই পাশের মাঠে এদের ঘোড়সওয়াররা ঘোড়া ছোটাবার খেলা দেখিয়ে দিলে মনে হল মরুভূমির ঘূর্ণ-হাওয়ার দল শরীর নিয়েছে। বোধ হচ্ছে আমার ভ্রমণ এই আরব বেদুয়িনে এসেই শেষ হল। দেশে যাত্রা করবার আর দু-তিন দিন বাকি, কিন্তু শরীর এত ক্লান্ত যে এর মধ্যে আর-কোনো দেখাশোনা চলবে না। তাই এই মরুভূমির বন্ধুত্বের মধ্যে ভ্রমণের উপসংহারটা ভালোই লাগছে। আমার বেদুয়িন নিমন্ত্রণকর্তাকে বললুম যে, বেলুয়িন-আতিথ্যের পরিচয় পেয়েছি, কিন্তু বেদুরিন-দস্যতার পরিচয় না পেলে তো অভিজ্ঞতা শেষ করে যাওয়া হবে না । তিনি হেসে বললেন, তার একটু বাধা আছে । আমাদের দসারা প্ৰাচীন জ্ঞানীলোকদের গায়ে হন্তক্ষেপ করে না। এইজন্যে মহাজনরা যখন আমাদের মরুভূমির মধ্যে দিয়ে পণ্য নিয়ে আসে তখন অনেক সময় বিজয় চেহারার প্রবীণ লোককে উটের পরে চড়িয়ে তাদের কর্তা সাজিয়ে আনে। আমি তাকে বললুম, চীনে ভ্ৰমণ করবার সময় আমার কোনো চৈনিক বন্ধুকে বলেছিলেম, ‘একবার টীনের ডাকাতের হাতে ধরা পড়ে আমার চীন ভ্রমণের বিবরণটাকে জমিয়ে তুলতে ইদহ করে।’ তিনি বললেন, চীনের ডাকাতেরা আপনার মতো বৃদ্ধ কবির পরে অত্যাচার করবে না, তারা প্ৰাচীনকে ভক্তি করে । সত্তর বছর বয়সে যৌবনের পরীক্ষা চলবে না । নানা স্থানে ঘোরা শেষ হল, বিদেশীর কাছ থেকে কিছু ভক্তি নিয়ে, শ্ৰদ্ধা নিয়েই দেশে ফিরে যাব, তার পরে আশা করি কর্মের অবসানে শক্তির অবকাশ আসবে। যুবকে যুবকে স্বত্ব ঘটে, সেই জ্বন্ধের আলোড়নে সংসারপ্রবাহের বিকৃতি দূর হয়। দস যখন বৃদ্ধিকে ভক্তি করে তখন সে তাকে আপন জগৎ থেকে দূরে সরিয়ে দেয় । যুবকের সঙ্গেই তার শক্তির পরীক্ষা, সেই জ্বন্ধের আঘাতে শক্তি প্ৰবল থাকে, অতএব ভক্তির সুদূর VENIRIM YNyffryk TR sure |