পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭১০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গ্রন্থপরিচয় Vebro সমবেদনার বাণী, তাই থেকেই এর গুণের প্রভূত পরিচয় পাওয়া যায় । সাহিত্যাকাশে ইনি । উজ্জ্বলতম তারকারাজির অন্যতম ; মানুষের চিন্তার মধ্যে ইনি সঞ্চারিত করেছেন যে কল্যাণের শক্তি তা যেমনি পবিত্র তেমনি নিষ্কলঙ্ক । ইন্দো-ইরান বংশের প্রতিনিধিদের মধ্যে ডক্টর ঠাকুর আদর্শস্থানীয়, প্ৰাচ্য মনীষার মধ্যে যা-কিছু সুন্দর ও মহীয়ান তারই প্ৰাণবান প্রতীক । তার বাণীর ঐশী শক্তি পাশ্চাত্য চিন্তা ও তথাকথিত সভ্যতাকে স্বীকার করিয়েছে যে বর্তমান যুগের এই জড়-চৈতন্যের নিরন্তর দ্বন্দ্বের মীমাংসনে প্রাচ্যের কিছু দেবার আছে, কিছু ক্ষমতা আছে । মনুষ্যত্বের প্রগতিতে তার রচনা ছন্দোরক্ষার সহায়তা করে, কারণ, আজ আমাদের পশ্চিমের ভ্রাতারা যে জড়রূপের মধ্যে একান্তভাবে নিবিষ্ট হয়ে আছেন এবং তার ফলে চরিত্রবিকৃতির যে আশঙ্কা ঘটছে, সেই আশঙ্কা দূর করবার জন্য জড়ের মধ্যে এই ঐকান্তিক অভিনিবেশের বিরুদ্ধে প্ৰতিবাদ প্রয়োজন । ডক্টর ঠাকুরের এই পারস্যপরিদর্শন যেমনি সন্তোষের বিষয় তেমনি গুরুফলপ্ৰসূ— কেননা, এতে আমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে পারস্যের বুদ্ধিগত কৃতিত্বের প্রতি উদার ভারতীয়দের কৌতুহল কতখানি, আমাদের মানসিক উৎকর্ষ ও সাহিত্যকে তারা কতখানি সমাদর করে । এই শ্ৰদ্ধেয় সাধু আজ আমাদের চিরকৃতজ্ঞতাপাশে বাধলেন, কেননা অল্পদিনের জন্যে হলেও এমন একজন মহাপুরুষের দীপ্তির কাছাকাছি আসার সৌভাগ্যটা সাধারণ লোকে যতখানি ভাবে তার চেয়ে অনেক বেশি । আমাদের কবি সাদি এক জায়গায় বলেছেন হায় মানুষ ! এই জগৎটা শুধু দৈহিক অহং'এর পুষ্টির জন্য নয় ; যথার্থ তত্ত্বজ্ঞানী মানুষের সন্ধান পাওয়া বড়োই কঠিন ; ভোরের পাখির সুরলহরী নিদ্ৰিত মানুষ জানে না ; মানুষের জগৎটা যে কী তা পশু কেমন করে জানবে । তেমনি সাধারণ লোকে না বুঝলেও এটা সত্য যে, ডক্টর ঠাকুরের এই পারস্যে আগমন সেই ভারতীয় জাতিরই মানসিক উৎকর্ষ ও নৈতিক আকাঙক্ষার নিদর্শন যে জাতি একটি অপরাপ পরিণতির দিকে অগ্রসর হচ্ছে । এমন জাতিই তার অতীত গৌরব আর উজ্বলতর ভবিষ্যৎ নিয়ে ন্যােয়ত দাবি করতে পারে যে, মানুষের চিন্তাকাশে অত্যুজ্বল তারকারাজির মধ্যে অনেকগুলি তারই, আর জগৎকে সে এক অতি গভীর দর্শনশাস্ত্ৰ দান করেছে । নীতিতত্ত্ব ও সৌন্দর্যতত্ত্বের দিক দিয়ে অতি প্ৰাচীনকাল থেকে এ দেশ ও ভারতবর্ষের মধ্যে একটা নিবিড় অচ্ছেদ্য যোগ রয়েছে। সাসানীয় যুগের প্রাচীনতম সাহিত্যের যে-সব পুঁথি আজ প্রচলিত আছে তার মধ্যেও পাওয়া যায় এই দুই জাতির পরস্পর আধ্যাত্মিক ভাববিনিময়ের কথা । দেখা যায়, আজকের যুগের মতো প্রাচীন পারস্যবাসীরাও ভারতবর্ষকে সম্রামের চোখে দেখত, গভীর চিন্তা ও নিগৃঢ় তত্ত্বরাজির দেশ হিসেবে। প্রথম সাসানীয় সম্রাট অর্দশির বাবেকনের কার্নামেতে বৰ্ণিত আছে যে, যখন তিনি তার রাজ্যসম্বন্ধে ভবিষ্যদবাণী শুনতে চান তখন কোনো ভারতীয় সম্রাটের নিকট তিনি দূত পাঠিয়েছিলেন । ফারদৌসীর শানামেতেও এ ęG \be, 1983 RTE | ইরানে ইসলামধর্মের প্রসার ও ভারতে তার প্রভাববিস্তৃতির পর থেকে ভারত-পারস্যের এই মিলনসূত্র পরিবর্তন পরম্পরার ভিতর দিয়ে নব নব তেজে দৃঢ়ীভূত হয়েছে- এবং আশা করা যায়, এর পরিসর ক্রমেই বিস্তৃত হবে । এইখানে আমাদের অতিথির অবগতির জন্য বলাটা প্রাসঙ্গিক হবে- বর্তমান মহারাজের নিকট পারস্যজাতি কতখানি ঋণী । চিরসতর্ক দৃষ্টি নিয়ে তিনি বিশৃঙ্খলের মধ্যে শৃঙ্খলা স্থাপন করেছেন ; অক্লান্ত উদ্যম ও অত্যাশ্চর্য গঠন-শক্তির দ্বারা তিনি এখানে এমন একটা শাসনযন্মের প্রতিষ্ঠা করেছেন যা সর্ববিষয়েই তার উন্নতিশীল প্রজাদের প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম। চতুর্দিক যখন ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন, দেশ যখন সর্বনাশের প্রান্তে এসে টলমল করছে, তখন যেন তিনি