পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৬৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

88 রবীন্দ্র-রচনাবলী কাছে অত্যন্ত মনোহর বলিয়া বোধ হইত না। সন্ধ্যাবেলায় নিয়মিত আসিয়া চন্দ্রবাবুর নিকট হইতে পাস করিবার উপযুক্ত নোট লইত ; এবং সে মনে মনে নিশ্চয় জানিত যে, চিরকৌমার্যত্রত না লওয়াতে এবং নিজের ভবিষ্যং মাটি করিবার জন্ত লেশমাত্র ব্যগ্র না হওয়াতে তাহার প্রতি চন্দ্রমাধববাবুর শ্রদ্ধামাত্র ছিল না, কিন্তু সেজন্ত সে কখনো অসহ দুঃখাতুভব করে নাই। তার পরে কী ঘটিল তাহা সকলেই জানেন । সেদিন সভা বসিয়াছে। চন্দ্রমাধববাবু বলিতেছেন, “আমাদের এই সভার সভ্যসংখ্যা অল্প হওয়াতে কারও হতাশ্বাস হবার কোনো কারণ নেই—” তাহার কথা শেষ না হইতেই রুগণকায় উৎসাহী শ্ৰীশ বলিয়া উঠিল, “হতাশ্বাস ! সেই তো আমাদের সভার গৌরব ! এ সভার মহং আদর্শ এবং কঠিন বিধান কি সর্বসাধারণের উপযুক্ত ! আমাদের সভা অল্প লোকের সভা।” চন্দ্রমাধববাবু কাৰ্যবিবরণের খাতাটা চোখের কাছে তুলিয়া ধরিয়া কহিলেন, “কিন্তু আমাদের আদর্শ উন্নত এবং বিধান কঠিন বলেই আমাদের বিনয় রক্ষা করা কর্তব্য ; সর্বদাই মনে রাখা উচিত আমরা আমাদের সংকল্প-সাধনের যোগ্য না হতেও পারি। ভেবে দেখে পূর্বে আমাদের মধ্যে এমন অনেক সভ্য ছিলেন র্যারা হয়তো আমাদের চেয়ে সর্বাংশে মহত্তর ছিলেন, কিন্তু তারাও নিজের স্বথ এবং সংসারের প্রবল আকর্ষণে একে একে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছেন। আমাদের কয়জনের পথেও ষে প্রলোভন কোথায় অপেক্ষা করছে তা কেউ বলতে পারে না । সেই জন্ত আমরা দম্ভ পরিত্যাগ করব, এবং কোনো রকম শপথেও বন্ধ হতে চাইনে— আমাদের মত এই যে, কোনোকালে মহং চেষ্টাকে মনে স্থান না দেওয়ার চেয়ে চেষ্টা করে অকৃতকাৰ হওয়া ভালো ।” পাশের ঘরে ঈষৎ মুক্ত দরজার অন্তরালে একটি শ্রোত্রী এই কথায় যে একটুখানি বিচলিত হইয়া উঠিল, তাহার অঞ্চলবদ্ধ চাবির গোছায় দুই-একটা চাৰি ৰে একটু ঠুন শব্দ করিল তাহ পূর্ণ ছাড়া আর কেহ লক্ষ্য করিতে পারিল না। চন্দ্রমাধববাবু বলিতে লাগিলেন, “আমাদের সভাকে অনেকেই পরিহাস করেন ; অনেকেই বলেন তোমরা দেশের কাজ করবার জন্য কৌমার্বত্রত গ্রহণ করছ, কিন্তু সকলেই যদি এই মহৎ প্রতিজ্ঞায় আবদ্ধ হয় তা হলে পঞ্চাশ বৎসর পরে দেশে এমন মানুষ কে থাকবে যার জন্তে কোনো কাজ করা কারও দরকার হবে। আমি প্রায়ই নম্র নিরুত্তরে এই সকল পরিহাস বহন করি ; কিন্তু এর কি কোনো উত্তর নেই ?” বলিয়া তিনি তাহার তিনটি মাত্ৰ সত্যের দিকে চাহিলেন। |