পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৭০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

88b- রবীন্দ্র-রচনাবলী হইতে পারে, কিন্তু ইহা ভারতবর্ষের প্রথা নহে, সুতরাং এই প্রকারের পূর্তকার্ষে আমাদের হৃদয় স্পর্শ করে না। না করুক, তথাপি বিলাতের রাজা বিলাতের প্রথামতই চলিবেন, ইহাতে বলিবার কথা কিছু নাই। কিন্তু কখনো দিশি কখনো বিলিতি হইলে কোনোটাই মানানসই হয় না। বিশেষত, আড়ম্বরের বেলায় দিশি দস্তুর এবং খরচপত্রের বেলায় বিলিতি দম্ভর হইলে আমাদের কাছে ভারি অসংগত ঠেকে। আমাদের বিদেশী কর্তারা ঠিক করিয়া বসিয়া আছেন যে, প্রাচ্য হৃদয় আড়ম্বরেই ভোলে, এই জন্যই ত্রিশ কোটি অপদার্থকে অভিভূত করিতে দিল্লির দরবার নামক একটা স্থবিপুল অত্যুক্তি বহু চিস্তায়-চেষ্টায় ও হিসাবের বহুতর কষাকবি -দ্বারা খাড়া করিয়া তুলিয়াছেন— জানেন না যে, প্রাচ্য হৃদয় দানে, দয়াদাক্ষিণ্যে, অবারিত মঙ্গল অনুষ্ঠানেই ভোলে। আমাদের ষে উৎসবসমারোহ তাহা আহত অনাহুত রবাহতের আনন্দসমাগম, তাহাতে এহি এহি দেহি দেহি পীয়তাং ভূজ্যতাং রবের কোথাও বিরাম ও বাধা নাই। তাহা প্রাচ্য আতিশয্যের লক্ষণ হইতে পারে, কিন্তু তাহ খাটি, তাহ স্বাভাবিক। আর পুলিসের দ্বারা সীমানাবদ্ধ, সঙিনের দ্বারা কণ্টকিত, সংশয়ের দ্বারা সন্ত্রস্ত, সতর্ক কৃপণতার দ্বারা সংকীর্ণ, দয়াহীন দানহীন ষে দরবার, যাহা কেবলমাত্র দম্ভপ্রচার, তাহ পাশ্চাত্য অত্যুক্তি— তাহাতে আমাদের হৃদয় পীড়িত ও লাঞ্ছিত হয়— আমাদের কল্পনা আকৃষ্ট না হইয়া প্রতিহত হইতে থাকে। তাহ ঔদার্থ হইতে উৎসারিত নহে, তাহ প্রাচুর্য হইতে উবেলিত হয় নাই । এই গেল নকল-করা অত্যুক্তি। কিন্তু নকল, বাহ আড়ম্বরে মূলকে ছাড়াইবার চেষ্টা করে এ কথা সকলেই জানে। স্বতরাং সাহেব যদি সাহেবি ছাড়িয়া নবাবি ধরে তবে তাহাতে যে আতিশয্য প্রকাশ হইয়া পড়ে তাহা কতকটা কৃত্রিম, অতএব তাহার দ্বারা জাতিগত অত্যুক্তির প্রকৃতি ঠিক ধরা যায় না। ঠিক খাটি বিলাতি অত্যুক্তির একটা দৃষ্টান্ত মনে পড়িতেছে। গবর্মেন্ট, সেই দৃষ্টান্ডটি আমাদের চোখের সামনে পাথরের স্তম্ভ দিয়া স্থায়িভাবে খাড়া করিয়া তুলিয়াছেন, তাই সেটা হঠাৎ মনে পড়িল। তাহ অন্ধকূপহত্যার অত্যুক্তি। পূর্বেই বলিয়াছি, প্রাচ্য অত্যুক্তি মানসিক চিলামি। আমরা কিছু প্রাচুপ্রিয়, জটাজাটি আমাদের সহে না। দেখো-না, আমাদের কাপড়গুলা চিলাচল, জাবগুকের চেয়ে অনেক বেশি ; ইংরেজের বেশভূষা কাটাছাট, ঠিক মাপসই— এমন-কি, আমাদের মতে তাহ আঁটিতে আঁটিতে কাটিতে কাটিতে শালীনতার সীমা ছাড়াইয়া গেছে। আমরা– হয় প্রচুরক্ষপে নগ্ন নয় প্রচুরক্ষপে আবৃত।