পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৮৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ઉ૭૬ রবীক্স-রচনাবলী নিজের বাসনাকে খর্ব করিতে না পারিলে ভগবানের ইচ্ছাকে অনুভব করিতে পারা যায় না। ভগবানের ইচ্ছার মধ্যে নিজের ইচ্ছাকে মুক্তিদানই মুক্তি। সেই মুক্তির প্রতি লক্ষ করিয়াই কর্মের শুভাশুভ স্থির করিতে হইবে। যাহার। অদ্বৈতানন্দকে লক্ষ্য করিয়াছেন তাহারাও বাসনামোহকে ছেদন করিতে উদ্যত, যাহারা কর্মের অনন্ত শৃঙ্খল হইতে মুক্তিপ্রার্থী র্তাহারাও বাসনাকে উৎপাটিত করিতে চান, ভগবানের প্রেমে যাহারা নিজেকে সম্মিলিত করাই শ্রেয় জ্ঞান করেন র্তাহারাও বিষয়বাসনাকে তুচ্ছ করিবার কথা বলিয়াছেন। যদি এই-সকল ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায়ের উপদেশগুলি কেবল আমাদের জ্ঞানের বিষয় হইত তাহা হইলে আমাদের পরস্পরের মধ্যে পার্থক্যের সীমা থাকিত না । কিন্তু এই ভিন্ন সম্প্রদায়গণ র্তাহাদের ভিন্ন ভিন্ন তত্ত্বকে কাজে লাগাইবার চেষ্টা করিয়াছেন। সে তত্ত্ব যতই স্বল্প বা যতই স্কুল হউক, সে তত্ত্বকে কাজের মধ্যে অনুসরণ করিতে হইলে যতদূর পর্যন্তই যাওয়া যাক, আমাদের গুরুগণ নিৰ্ভীকচিত্তে সমস্ত স্বীকার করিয়া সেই তত্ত্বকে কর্মের দ্বারা সফল করিতে চেষ্টা করিয়াছেন। ভারতবর্ষ কোনো বড়ো কথাকে অসাধ্য বা সংসারযাত্রার সহিত অসংগত-বোধে কোনো দিন ভীরুতাবশত কথার কথা করিয়া রাখে নাই। এজন্য এক সময়ে যে ভারতবর্ষ মাংসাশী ছিল সেই ভারতবর্ষ আজি প্রায় সর্বত্রই নিরামিষাশী হইয়া উঠিয়াছে। জগতে এরূপ দৃষ্টান্ত অন্ত কোথাও পাওয়া যায় না। যে যুরোপ জাতিগত সমুদয় পরিবর্তনের মূলে স্থবিধাকেই লক্ষ্য করেন র্তাহারা বলিতে পারেন যে, কৃষির ব্যাপ্তিসহকারে ভারতবর্ষে আর্থিক কারণে গোমাংসভক্ষণ রহিত হইয়াছে। কিন্তু মন্ত্র প্রভৃতি শাস্ত্রের বিধান-সত্ত্বেও অন্ত-সকল মাংসাহারও, এমন-কি মৎস্তভোজনও ভারতবর্ষের অনেক স্থান হইতেই লোপ পাইয়াছে। কোনো প্রাণীকে হিংসা করিবে না, এই উপদেশ জৈনদের মধ্যে এমন করিয়া পালিত হইতেছে যে, তাহা স্থবিধার তরফ হইতে দেখিলে নিতাস্ত বাড়াবাড়ি না মনে করিয়া থাকিবার জো নাই। বাহাই হউক, তত্ত্বজ্ঞান যতদূর পৌঁছিয়াছে ভারতবর্ষ কর্মকেও ততদূর পর্যন্ত টানিয়া লইয়া গেছে। ভারতবর্ষ তত্বের সহিত কর্মের ভেদসাধন করে নাই। এই জন্ত আমাদের দেশে কর্মই ধর্ম। আমরা বলি, মানুষের কর্মমাত্রেরই চরম লক্ষ্য কর্ম হইতে মুক্তি— এবং মুক্তির উদ্দেশে কর্ম করাই ধর্ম। পূর্বেই বলিয়াছি, তত্বের মধ্যে আমাদের যতই পার্থক্য থাক, কর্মে আমাদের ঐক্য আছেঃ অদ্বৈতাম্বভূতির মধ্যেই মুক্তি বল, আর বিগতসংস্কার নির্বাণের মধ্যেই মুক্তি বল, আর ভগবানের অপরিমেয় প্রেমানদের মধ্যেই মুক্তি বল-প্রকৃতিভেদে যে যুক্তির