পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৫২০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রবীজ-রচনাবলী মহিমায় অভ্ৰভেদী করিয়া তুলে– তেমনি এই ব্রাহ্মণতনয় জন্মদারিদ্র্য এবং সর্বপ্রকার প্রতিকূলতার মধ্যেও কেবল নিজের মজ্জাগত অপর্যাপ্ত বলবুদ্ধির দ্বারা নিজেকে যেন অনায়াসেই এমন সরল, এমন প্রবল, এমন সমুন্নত, এমন সর্বসম্পংশালী করিয়া তুলিয়াছিলেন। মেট্রোপলিটান বিদ্যালয়কে তিনি যে একাকী সর্বপ্রকার বিয়বিপত্তি হইতে রক্ষা করিয়া তাহাকে সগৌরবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহিত সংযুক্ত করিয়া দিলেন, ইহাতে বিদ্যাসাগরের কেবল লোকহিতৈষী ও অধ্যবসায় নহে, তাহার সজাগ ও সহজ কর্মবুদ্ধি প্রকাশ পায়। এই বুদ্ধিই যথার্থ পুরুষের বুদ্ধি— এই বুদ্ধি স্বদুরসম্ভবপর কাল্পনিক বাধাবিন্ন ও ফলাফলের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিচারজালের দ্বারা আপনাকে নিরুপায় অকৰ্মণ্যতার মধ্যে জড়ীভূত করিয়া বসে না ; এই বুদ্ধি, কেবল সূক্ষ্মভাবে নহে, প্রত্যুত প্রশস্তভাবে সমগ্রভাবে কর্ম ও কর্মক্ষেত্রের আদ্যোপান্ত দেখিয়া লইয়া, দ্বিধা বিসর্জন দিয়া, মুহূর্তের মধ্যে উপস্থিত বাধার মর্মস্থল আক্রমণ করিয়া, বীরের মতে কাজ করিয়া যায়। এই সবল কর্মবুদ্ধি বাঙালির মধ্যে বিরল। যেমন কর্মবুদ্ধি তেমনি ধর্মবুদ্ধির মধ্যেও একটা সবল কাগুজ্ঞান থাকিলে তাহার দ্বারা যথার্থ কাজ পাওয়া যায়। কবি বলিয়াছেন : ধর্মস্ত সূক্ষ্মা গতিঃ । ধর্মের গতি সূক্ষ্ম হইতে পারে, কিন্তু ধর্মের নীতি সরল ও প্রশস্ত। কারণ, তাহা বিশ্বসাধারণের এবং নিত্যকালের। তাহা পণ্ডিতের এবং তার্কিকের নহে। কিন্তু মন্থন্যের দুর্ভাগ্যক্রমে মানুষ আপন সংস্রবের সকল জিনিসকেই অলক্ষিতভাবে কৃত্রিম ও জটিল করিয়া তুলে। যাহা সরল, যাহা স্বাভাবিক, যাহা উন্মুক্ত-উদার, যাহা মূল্য দিয়া কিনিতে হয় না, বিধাতা যাহা আলোক ও বায়ুর স্থায় মচুন্যসাধারণকে অম্বাচিত দান করিয়াছেন, মানুষ আপনি তাহাকে দুর্মল্য দুর্গম করিয়া দেয়। সেই জন্য সহজ কথা ও সরল ভাব প্রচারের জন্ত লোকোত্তর মহত্ত্বের অপেক্ষা করিতে হয়। * বিদ্যাসাগর বালবিধবাবিবাহের ঔচিত্য সম্বন্ধে যে প্রস্তাব করিয়াছেন তাহীও অত্যন্ত সহজ ; তাহার মধ্যে কোনো নূতনত্বের অসামান্ত নৈপুণ্য নাই। তিনি প্রত্যক্ষ ব্যাপারকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করিয়া এক অমূলক কল্পনালোক স্বজন করিতে আপন শক্তির অপব্যয় করেন নাই। তিনি তাহার বিধবাবিবাহগ্রন্থে জামাদিগকে সম্বোধন করিয়া যে আক্ষেপোক্তি প্রকাশ করিয়াছেন তাহ উদ্ভূত করিলেই আমার কথাটি পরিষ্কার হইবে।— ‘হ ভারতবর্ষীয় মানবগণ!” অভ্যাসদোষে তোমাদের বুদ্ধিবৃত্তি ও বর্গপ্রবৃত্তি