পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৫৩৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

*>२ রবীন্দ্র-রচনাবলী মহাত্মাদের প্রতি মাঝে মাঝে দৃষ্টিপাত করা আমাদের নিতান্ত জীবগুক । মহাত্মাদের জীবন আলোচনা করিলে মচুন্যত্ব যে কী তাহা বুঝিতে পারি, “আমরা মানুষ বলিলে যে কতখানি বলা হয় তাহা উপলব্ধি করিতে পারি, জানিতে পারি ষে আমরা কেবল অস্থিচর্মনির্মিত একটা আহার করিবার যন্ত্র মাত্র নই, আমাদের স্বমহৎ কুলমর্যাদার খবর পাইয়া থাকি। আমরা যে আমাদের চেয়ে ঢের বড়ো, অর্থাৎ মহন্ত, সাধারণ মানুষদের চেয়ে যে অনেক পরিমাণে শ্রেষ্ঠ, ইহাই মনের মধ্যে অনুভব করিলে তবে আমাদের মাথা তুলিতে ইচ্ছা করে, মৃত্তিকার আকর্ষণ হ্রাস হইয়া যায়। মহাপুরুষেরা সমস্ত মানবজাতির গৌরবের ও আদর্শের স্থল বটেন, কিন্তু তাহারা জাতিবিশেষের বিশেষ গৌরবের স্থল তাহার আর সন্দেহ নাই। গৌরবের স্থল বলিলে যে কেবলমাত্র সামান্য অহংকারের স্থল বুঝায় তাহা নহে, গৌরবের স্থল বলিলে শিক্ষার স্থল, বললাভের স্থল বুঝায়। মহাপুরুষদিগের মহংকার্যসকল দেখিয়া কেবলমাত্র সন্ত্রমমিশ্রিত বিস্ময়ের উদ্রেক হইলেই যথেষ্ট ফললাভ হয় না— তাহদের যতই ‘আমার’ মনে করিয়া তাহাদের প্রতি যতই প্রেমের উদ্রেক হয় ততই তাহাদের কথা, তাহাদের কার্য, তাহাদের চরিত্র আমাদের নিকট জীবন্ত হইয় উঠে। যাহাদের লইয়া আমরা গৌরব করি তাহাজের শুদ্ধমাত্র যে আমরা ভক্তি করি তাহা নহে, তাহীদের ‘আমার’ বলিয়া মনে করি। এইজন্ত র্তাহীদের মহত্ত্বের আলোক বিশেষরূপে আমাদেরই উপরে আসিয়া পড়ে, বিশেষরূপে আমাদেরই মুখ উজ্জল করে। শিশু যেমন সহস্ৰ বলবান ব্যক্তিকে ফেলিয়া বিপদের সময় পিতার কোলে আশ্রয় লইতে যায়, তেমনি আমরা দেশের দুৰ্গতির দিনে আর-সকলকে ফেলিয়া আমাদের স্বদেশীয় মহাপুরুষদিগের অটল আশ্রয় অবলম্বন করিবার জন্ত ব্যাকুল হই। তখন আমাদের নিরাশ হৃদয়ে তাহারা যেমন বলবিধান করিতে পারেন এমন আর কেহই নহে। ইংলণ্ডের দুর্গতি কল্পনা করিয়া কবি ওজার্ডসওআর্থ পৃথিবীর আর-সমস্ত মহাপুরুষকে ফেলিয়া কাতর স্বরে মিন্টনকেই ডাকিলেন ; কহিলেন, "মিণ্টন, জাহ, তুমি যদি আজি বাচিয় থাকিতে ! তোমাকে ইংলণ্ডের বড়োই আবশুক হইয়াছে।’ ষে জাতির মধ্যে স্বদেশীয় মহাপুরুষ জন্মান নাই সে জাতি কাহার মুখ চাহিবে— তাহার কী দুর্দশা! কিন্তু, যে জাতির মধ্যে মহাপুরুষ জন্মগ্রহণ করিয়াছেন কিন্তু তথাপিও বে জাতি কল্পনার জড়তা— হৃদয়ের পক্ষাঘাত -বশত র্তাহার মহত্ব কোনোমতে অল্পভব করিতে পারে না, তাহার কী দুর্ভাগ্য।