পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৫৪৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চারিত্রপূজা 《: ) ক্ৰমাগত হীনতার অন্ধকূপে নিমগ্ন হইতেছে, আমাদের পৈতৃক সম্পদ যে ভাণ্ডারে প্রচ্ছন্ন আছে রামমোহন রায় সেই ভাণ্ডারের দ্বার উদঘাটন করিয়া দিলেন— আমরা কি গৌরবের সহিত মনের সাধে আমাদের দারিদ্র্যছঃখ দূর করিতে পারিব! আমাদের দীনহীন জাতিকে এই একমাত্র গৌরব হইতে কোন নিষ্ঠুর বঞ্চিত করিতে চাহে । আর-একটা কথা জিজ্ঞাসা করি— ব্ৰহ্মকে পাইয়া কি আমাদের হৃদয়ের পরিপূর্ণ পরিতৃপ্তি হয় না? আমাদের ব্ৰহ্ম কি কেবলমাত্র নীরস দর্শনশাস্ত্রের ব্ৰহ্ম ? তাহা যদি হইত তবে কি ঋষিরা তাহীদের সমস্ত জীবন এই ব্ৰহ্মতে নিমগ্ন করিয়া রাখিতে পারিতেন, তাহাদের সংসারের সমস্ত সুখদুঃখ এই ব্রন্ধে গিয়া নির্বাণ প্রাপ্ত হইত ? প্রেমের ঈশ্বর কি বিদেশী ধর্মে আছে, আমাদের ধর্মে নাই ? না, তাহ নয় । আমাদের ব্রহ্ম— রসো বৈ সঃ । তিনি রসস্বরূপ । আমাদের ব্রহ্ম আনন্দস্বরূপ । কো হেবান্তাৎ কঃ প্রাণ্যাং যদেষ আকাশ আনন্দো ন তাৎ । এয হেবানন্দয়াতি । এই আনন্দ সমস্ত আকাশ পরিপূর্ণ করিয়া আছেন বলিয়াই আমাদের বাচিয়৷ আনন্দ। এইজন্ত পুষ্পে আনন্দ, সমীরণে আনন্দ । এইজন্য পুত্রের মুখ দেখিয়া আনন্দ, বন্ধুর মিলনে আনন্দ, নরনারীর প্রেমে আনন্দ । এইজন্যই, আনন্দং ব্রহ্মণো বিদ্বান ন বিভেতি কদাচন। এই আনন্দকে পাইলে ভয় থাকে না, আনন্দের অবসান থাকে না। এত পাইয়াও কি হৃদয়ের আকাঙ্ক্ষা অবশিষ্ট থাকে ? এমন অসীম আনন্দের আকর ঋষির আবিষ্কার করিয়াছেন ও আমাদের জন্ত রাখিয়া গিয়াছেন, তবে কিসের জন্ত অন্যত্র যাইব ? ঋষিদের উপার্জিত, ভারতবর্ষীয়দের উপার্জিত, আমাদের উপার্জিত এই আনন্দ আমরা পৃথিবীময় বিতরণ করিব। এইজন্ত রামমোহন রায় আমাদিগকে আমাদেরই ব্রাহ্মধর্ম দিয়া গিয়াছেন। আমাদের ব্রন্ধ যেমন নিকট হইতে নিকটতর, আত্মা হইতেও আত্মীয়তর, এমন আর কোনো দেশের ঈশ্বর নহেন। রামমোহন রায় ঋষিপ্রদর্শিত পথে সেই আমাদের পরমাত্মীয়ের সন্ধান পাইয়াছেন, আমাদিগকেও সেই পথ দেখাইয়া দিয়াছেন। তিনি যদি স্পর্ধিত হইয়া নূতন পথ অবলম্বন করিতেন তবে আমাদিগকে কতদূরেই ভ্রমণ করিতে হইত— তবে আমাদের হৃদয়ের এমন অসীম পরিতৃপ্তি হইত না, তবে সমস্ত ভারতবাসী বিশ্বাস করিয়া উপহার সেই নূতন পথের দিকে চাহিয়াও দেখিত না । তিনি যে ক্ষুত্র অভিমানে অথবা উদারতা প্রভৃতি দুইএকটা কথার প্রলোভনে পুরাতনকে পরিত্যাগ করেন নাই, এই তাহার প্রধান মহত্ব। বাস্তবিক, একটু ভাবিয়া দেখিলেই দেখা যায়, জানের কথায় আর ভাবের কথায় একই নিয়ম খাটে না। জ্ঞানের কথাকে ভাষান্তরিত করিলে তাহার তেমন ক্ষতি হয় না, কিন্তু ভাবের কথাকে ভাষাবিশেষ হইতে উৎপাটিত করিয়া তাহাকে তাৰাস্তরে