পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৫৪৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চারিত্রপূজা 43లి আমাদের মধ্যে আচ্ছন্ন হইয়া আছে। তাহাকেই তিনি জাগ্রত করিয়া তুলিলেন। আমাদের চেষ্টা হউক, জামাদের এই জীবনকে সতেজ করিয়া তুলি— তবে আমরা ক্রমে বিদেশীয় সত্য আপনার করিতে পারিব । তাও যে সকল সময়ে সকল অবস্থায় সম্পূর্ণ করিতে পারিব, এমন ভরসা নাই। আমাদের জঠরানলেরও যেমন এমন সার্বভৌমিক উদারতা নাই ষে সমস্ত খাস্তকে সমান পরিপাক করিতে পারে, আমাদের হৃদয়েরও সেই দশা— কী করা যায়, উপায় নাই। এইজন্তই বলি, প্রাচীন ঋষিদের উপনিষদের ব্রহ্মনাম উচ্চারণ করিয়া আগে আমাদের দেশে ঈশ্বরের সিংহাসন প্রতিষ্ঠা করিয়া লই, তাহার পরে সার্বভৌমিকতার দিকে মনোযোগ দেওয়া যাইতে পারে। ঈশ্বর যেমন সকলের ঈশ্বর তেমনি তিনি প্রত্যেকের ঈশ্বর, যেমন তিনি জ্ঞানের ঈশ্বর তেমনি তিনি হৃদয়ের ঈশ্বর, তিনি যেমন সমস্ত জগতের দেবতা তেমনি আমাদের গৃহদেবতা। র্তাহাকে রাজা বলিয়াও দেখিতে পারি, তাহাকে পিতা বলিয়াও দেখিতে পারি। কিন্তু পিতা ঈশ্বর আমাদের যত নিকটের, তিনি আমাদের হৃদয়ের যত অভাব মোচন করেন, এমন রাজা ঈশ্বর নহেন। তেমনি ব্ৰহ্ম ভারতবর্ষের গৃহদেবতা, তিনি ভারতবর্ষের পিতা। তিনি ভারতের হৃদয়ের যত নিকটবর্তী, তিনি ভারতের অভাব যত বুঝিবেন, এমন আর কেহ নহে। ব্ৰহ্মই ভারতবর্ষের জাগ্রত দেবতা ; জিহোবা, গড, অথবা আল্লা আমাদের ভাবের সম্পূর্ণ গম্য নহেন। রামমোহন রায় হৃদয়ের উদারত-বশত ইহা বুঝিয়াছিলেন। সংকীর্ণ দৃষ্টি হইলে ভারতের এ মর্মাস্তিক অভাব হয়তো তাহার চক্ষে পড়িত না। পিতামহ ঋষিরা যে ব্ৰহ্মকে বহু সাধন-দ্বারা আবাহন করিয়া আমাদের ভারতবাসীর হৃদয়ের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিলেন, আমাদের হীনতা-অন্ধকারে যে ব্রন্ধের মূর্তি এতদিন আচ্ছন্ন হইয়া আছে, রামমোহন রায় সেই ব্ৰহ্মকে আমাদের হৃদয়ে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করিতে উষ্ঠত হইয়াছেন ; আমরা যদি তাহার সেই শুভসংকল্প সিদ্ধ করি তবেই তাহার চিরস্থায়ী স্মরণস্তম্ভ পৃথিবীতে স্থাপন করিতে পারিব। আমরা অগ্ৰে ভারতবর্ষের মন্দিরে সনাতন ব্রহ্মের প্রতিষ্ঠা করিব ; অবশেষে এমন হইবে যে, পৃথিবীর চারি দিক হইতে ধর্মার্থীরা ভারতবর্ষের তীর্থক্ষেত্রে ব্ৰহ্মদৰ্শন-লালসায় দলে দলে আগমন করিতে থাকিবে । তখনই রাজ রামমোহন রায়ের জয় । তিনি ষে সত্যের পতাকা ধরিয়া ভারতভূমিতে দাড়াইয়াছিলেন সেই পুরাতন সত্যের জয়। তখন সেই রামমোহন রায়ের জয়ে, ঋষিদের জয়ে, সত্যের জয়ে, ব্রন্ধের জয়ে আমাদের ভারতবর্ষেরই জয় । মাঘ ১২৯১ 8|\9&