পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৬৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৩৫২ : রবীন্দ্র-রচনাবলী । ত্ৰিভুবনের সম্মতিক্রমে। এ কথা গুরুদেবের অগোচর নাই যে, মর্তলোকেই দেবতাদের নির্বাচন হইয়া থাকে। এক কালে আর্যাবর্তের সমস্ত ব্ৰাহ্মণ হােতাগণ আমাকেই স্বর্গের প্রধানপদ দিয়াছিলেন এবং তৎকালে সরস্বতী-দৃশদ্বতীতীরের প্রত্যেক যজ্ঞহুতাশনে আমার উদ্দেশে অহরহ যে হবি সমৰ্পিত হইত তাহার হােমধুমে আমার সহস্ৰলোচন হইতে নিরন্তর অশ্রু প্রবাহিত হইত। অদ্য নরলোকে হবিবৃত কেবলমাত্ৰ জঠরযজ্ঞে ক্ষুধাসুরের উদ্দেশেই উপহৃত হইয়া থাকে এবং শুনিতে পাই সে ঘূতও বিশুদ্ধ নহে । k বৃহস্পতি। বৃত্ৰনিসূদন, সেই অপবিত্র বিমিশ্র ঘূত-পানে, শুনিতে পাই, ক্ষুধাসুর মৃতপ্রায় হইয়া আসিয়াছে। হে শত্ৰু, দেবতাদের প্রতি দেবদেবের বিশেষ কৃপা আছে, সেইজন্যই নরলোকে হােমাগ্নি অমৃত্যরস সুতীব্ৰ অমরসে পরিণত হইত, অগ্নিদেবের মন্দাগ্নি এবং বায়ুদেবের বায়ুপরিবর্তন আবশ্যক হইত, এবং সমস্ত দেবতার অমরবক্ষে অসহ্য শূলবেদনা অমর হইয়া বাস করিত। ইন্দ্র। হে জ্ঞানিশ্রেষ্ঠ, উক্ত ঘূতের গুণাগুণ আমার অবিদিত নাই, যেহেতু যমরাজের নিকট সর্বদাই । তাহার বিবরণ শুনিতে পাই। অতএব হাব্যপদার্থে আমার কিছুমাত্র লোভ নাই, এবং হােমাগ্নির তিরোধান সম্বন্ধেও আমি আক্ষেপ করিতেছি না। আমার বক্তব্য এই যে, যেমন পুষ্প হইতে সৌরভ। উখিত হয় তেমনি মর্তের ভক্তি হইতেই স্বৰ্গ উধ্বলোকে উদবাহিত হইতে থাকে ; সেই ভক্তিপুষ্প যদি শুষ্ক হইয়া যায়। তবে, হে দ্বিজসত্তম, তেত্ৰিশ কোটি দেবতাও আমার এই পারিজাতমোদিত নন্দনবনবেষ্টিত স্বৰ্গলোক রক্ষা করিতে পরিবে না। সেই কারণে, মর্তের সহিত যোগপ্রবাহ রক্ষা করিবার জন্য মাঝে মাঝে নরলোকের নবনির্বাচিত দেবতাগুলিকে সাদরে স্বৰ্গে আবাহন করিয়া আনিতে হয়। হে ত্রিকালজ্ঞ, স্বর্গের ইতিহাসে এমন ঘটনা ইতিপূর্বেও ঘটিয়াছে। বৃহস্পতি । মেঘবাহন, সে-সমস্ত ইতিহাস আমার অগোচর নাই। কিন্তু ইতিপূর্বে যে-সকল নূতন দেবতা মর্ত হইতে স্বৰ্গলোকে উন্নীত হইয়াছিলেন তাহারা অভিজাত দেবগণের সহিত একাসনে বসিবার উপযুক্ত। সম্প্রতি ঘেটুপ্রমুখ যো-সমস্ত দেবতাগণ তোমার নিমন্ত্রণে স্বৰ্গে আসিয়া আশ্রয় লইয়াছেন তাহারা সুরসভার দিব্যজ্যোতি স্নান করিয়া দিয়াছেন। অদিতিনন্দন, আমার প্রস্তাব এই যে, তঁহাদের জন্য একটি উপদেবলোক সৃজন করিবার জন্য বিশ্বকর্মর প্রতি বিশেষ ভারার্পণ করা হয়। ইন্দ্ৰ। বুধপ্রবর, তাহা হইলে সেই উপস্বৰ্গই স্বৰ্গ হইয়া দাড়াইবে এবং স্বৰ্গ উপসর্গ হইবে মাত্র । একমাত্র বেদমন্ত্রের উপর আমাদের স্বৰ্গ প্রতিষ্ঠিত | জর্মনদেশীয় পণ্ডিতগণের বহুল চেষ্টা সত্ত্বেও সে মন্ত্র এবং তাহার অর্থ সকলে বিস্মৃত হইয়া আসিয়াছে। কিন্তু আমাদের নূতন আমন্ত্রিত দেবদেবীগণ, সায়নাচার্যের ভাষ্য, পাশ্চাত্য ঐতিহাসিকদের পুরাতত্ত্ব অথবা তীহাদের প্রাচ্যশিষ্যবর্গের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার উপর নির্ভর করিতেছেন না, তাহারা প্রতিদিনের সদ্য-আহরিত পূজা প্রাপ্ত হইয়া উপবাসী পুরাতন দেবতাদের অপেক্ষা অনেকগুণে প্রবল হইয়া উঠিয়াছেন। তঁহাদিগকে স্বপক্ষে পাইলে আমরা নূতন বল লাভ করিতে পারিব। অতএব, গুরুদেব, প্রসন্নচিত্তে র্তাহাদের কণ্ঠে দেবমলা অর্পণ করিয়া র্তাহাদিগকে স্বৰ্গলোকে বরণ করিয়া লউন । বৃহস্পতি। অহাে দুৰ্বত্তা নিয়তি! মর্তলোকের প্রসাদ লাভলালসায় কত পুরাতন দেবকুলপ্রদীপ ক্রমশ আপন দেবমর্যাদা বিসর্জন দিয়াছেন। দেবসেনাপতি কার্তিকেয় বীরবেশ পরিত্যাগ করিয়া সূক্ষ্মবাসন লম্বকচ্ছে কামিনীমনোমোহন নির্লজ্জ নাগরমূর্তি ধারণ করিয়াছেন ! গভীরপ্রকৃতি গণপতি কদলীতরুর সহিত গোপন-পরিণয়পাশে বদ্ধ হইয়াছেন এবং মহাযোগী মহেশ্বর গঞ্জিকা-ধূস্তুরসিদ্ধি-পানে উন্মত্ত হইয়া মহাদেবীর সহিত অশ্রাব্য ভাষায় কলহ করিয়া নীচজাতীয় স্ত্রীপঞ্জীর মধ্যে আপন বিহারক্ষেত্র বিস্তার করিয়াছেন । সে-সমস্তই যখন একে একে সহ্য করিতে পারিয়াছি তখন বোধ উপদবেতাগণের অধিরোহণদৃশ্যও এই বৃদ্ধ ব্ৰাহ্মণের ধৈর্যকঠিন বক্ষঃস্থল বিদীর্ণ করিতে