পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৪৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

80& রবীন্দ্র-রচনাবলী বলিলেন, শচীশ, এই মেয়েটি আজ যে লজ্জা বহন করিতেছে সে যে আমার লজ্জা, তোমার লজ্জা । আহা, ওর উপরে এতবড়ো বোঝা কে চাপাইল ! - মা, আমার কাছে তোমার লজ্জা খাটিবে না। আমাকে আমার ইস্কুলের ছেলেরা পাগলা জগাই বলিত, আজও আমি সেই পাগল আছি।-বলিয়া জগমোহন নিঃসংকোচে মেয়েটির দুই হাত ধরিয়া। মাটি হইতে তাকে দাড় করাইলেন ; মাথা হইতে তার ঘোমটা খসিয়া পড়িল । নিতান্ত কচিমুখ, অল্প বয়স, সে মুখে কলঙ্কের কোনো চিহ্ন পড়ে নাই। ফুলের উপরে ধুলা লাগিলেও যেমন তার আন্তরিক শুচিতা দূর হয় না তেমনি এই শিরীষ-ফুলের মতো মেয়েটির ভিতরকার পবিত্রতার লাবণ্য তো ঘোচে নাই। তার দুই কালো চােখের মধ্যে আহত হরিণীর মতো ভয়, তার সমস্ত দেহলতাটির মধ্যে লজ্জার সংকোচ, কিন্তু এই সরল সকরুণতার মধ্যে কালিমা তাে কোথাও নাই । ፡፡ ননিবালাকে জগমোহন তার উপরের ঘরে লইয়া গিয়া বলিলেন, মা, এই দেখো আমার ঘরের শ্ৰী । সাত জন্মে বঁট পড়ে না ; সমস্ত উলটাপালটা ; আর আমার কথা যদি বল, কখন নাই, কখন খাই, তার ঠিকানা নাই। তুমি আসিয়াছ, এখন আমার ঘরের শ্ৰী ফিরিবে, আর পাগলা জগাইও মানুষের মতো হইয়া উঠিবে। মানুষ যে মানুষের কতখানি তা আজকের পূর্বে ননিবালা অনুভব করে নাই, এমন-কি, মা থাকিতেও না। কেননা মা তো তাকে মেয়ে বলিয়া দেখিত না, বিধবা মেয়ে বলিয়া দেখিত ; সেই সম্বন্ধের পথ যে আশঙ্কার ছােটাে ছােটাে কাটায় ভরা ছিল। কিন্তু, জগমোহন সম্পূর্ণ অপরিচিত হইয়াও ননিবালাকে তার সমস্ত ভালোমন্দর আবরণ ভেদ করিয়া এমন পরিপূর্ণরূপে গ্ৰহণ করিলেন কী করিয়া ! জগমোহন একটি বুড়ি ঝি রাখিয়া দিলেন এবং ননিবালাকে কোথাও কিছু সংকোচ করিতে দিলেন না। ননির বড়ো ভয় ছিল জগমোহন তার হাতে খাইবেন কি না, সে যে পতিতা। কিন্তু এমনি ঘটিল। জগমোহন তার হাতে ছাড়া খাইতেই চান না ; সে নিজে রাধিয়া কাছে বসিয়া না খাওয়াইলে তিনি খাইবেন না, এই তার পণ । জগমোহন জানিতেন, এইবার আর-একটা মস্ত নিন্দার পালা আসিতেছে। ননিও তাঁহা বুঝিত, এবং সেজন্য তার ভয়ের অন্ত ছিল না। দু-চার দিনের মধ্যেই শুরু হইল। ঝি আগে মনে করিয়াছিল, ননি জগমোহনের মেয়ে ; সে একদিন আসিয়া ননিকে কী-সব বলিল এবং ঘূণা করিয়া চাকরি ছাড়িয়া দিয়া গেল। জগমোহনের কথা ভাবিয়া ননির মুখ শুকাইয়া গেল। জগমোহন কহিলেন, মা, আমার ঘরে পূৰ্ণচন্দ্ৰ উঠিয়াছে, তাই নিন্দায় কোটালের বান ডাকিবার সময় আসিল ; কিন্তু ঢেউ যতই ঘোলা হউক, আমার জ্যোৎস্নায় তো দাগ লাগিবে না । জগমোহনের এক পিসি হরিমোহনের মহল হইতে আসিয়া কহিলেন, ছিছি, এ কী কাণ্ড জগাই ! পাপ বিদায় করিয়া দে । 蟒 জগমোহন কহিলেন, তোমরা ধামিক, তোমরা এমন কথা বলিতে পাের, কিন্তু পাপ যদি বিদায় করি তবে এই পাপিষ্ঠের গতি কী হইবে ? 鲁 সমস্ত খরচ দিতে রাজি আছে। । জগমোহন কহিলেন, মা যে ! টাকার সুবিধা হইয়াছে বলিয়াই খামক মাকে হাসপাতালে পাঠাইব ? হরিমােহনের এ কেমন কথা! . দিদিমা গালে হাত দিয়া কহিলেন, মা বলিস কাকে রে ! জগমোহন কহিলেন, জীবকে যিনি গর্ভে ধারণ করেন তাকে । যিনি প্ৰাণসংশয় করিয়া ছেলেকে জন্ম দেন তাকে । সেই ছেলের পাষণ্ড ব্যাপকে তো আমি বাপ বলি না। সে বেটা কেবল বিপদ বাধায়, তার তো কোনো বিপদই নাই । হরিমোহনের সর্বশরীর ঘূণায় যেন ক্লেদাসিক্ত হইয়া গেল। গৃহস্থের ঘরের দেওয়ালের ও পাশেই