পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৪৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8૭, রবীন্দ্র-রচনাবলী দাওয়া আঙিনা লোকে লোকারণ্য। সমস্ত সকল কীর্তন হইয়া গেছে। যে-সব লোক দূর হইতে আসিয়াছে তাহদের আহারের জোগাড় চলিতেছে। । আমাকে দেখিয়া শচীশ দুটিয়া আসিয়া আমাকে বুকে চাপিয়া ধরল। আমি অবাক হইলাম। শচীশ চিরদিন সংযত, তার স্তব্ধতার মধ্যে তার হৃদয়ের গভীরতার পরিচয় । আজ মনে হইল শচীশ নেশা করিয়াছে। স্বামীজি ঘরের মধ্যে বিশ্রাম করিতেছিলেন। দরজার একটা পাল্লা একটু খোলা ছিল। আমাকে দেখিতে পাইলেন। গভীর কণ্ঠে ডাক দিলেন, শচীশ ! ব্যস্ত হইয়া শচীশ ঘরে গেল। স্বামীজি জিজ্ঞাসা করিলেন, ও কে ? শচীশ বলিল, শ্ৰীবিলাস, আমার বন্ধু। তখনই লোকসমাজে আমার নাম রটিতে শুরু হইয়াছিল। আমার ইংরেজি বক্তৃতা শুনিয়া কোনাে একজন বিদ্বান ইংরেজ বলিয়ছিলেন, ও লোকটা এমন— থাক, সে-সব কথা লিখিয়া অনর্থক শক্রবৃদ্ধি করিব না। আমি যে ধুরন্ধর নাস্তিক এবং ঘণ্টায় বিশ-পঁচিশ মাইল বেগে আশ্চর্য কায়দায় ইংরেজি বুলির চৌম্বুড়ি হাঁকাইয়া চলিতে পারি, এ কথা ছাত্রসমাজ হইতে শুরু করিয়া ছাত্রদের পিতৃসমাজ পর্যন্ত রাষ্ট্র হইয়াছিল। আমার বিশ্বাস, আমি আসিয়াছি জানিয়া স্বামীজি খুশি হইলেন। তিনি আমাকে দেখিতে চাহিলেন। ঘরে ঢুকিয়া একটা নমস্কার করিলাম ; সে নমস্কারে কেবলমাত্র দুইখানা হাত খাড়ার মতো আমার কপাল পর্যন্ত উঠিল, মাথা নিচু হইল না। আমরা জ্যাঠামশায়ের চেলা, আমাদের নমস্কার গুণহীন ধনুকের মতো নমো অংশটা ত্যাগ করিয়া বিষম খাড়া হইয়া উঠিয়াছিল। স্বামীজি সেটা লক্ষ্য করলেন এবং শচীশকে বলিলেন, তামাকটা সাজিয়া দাও তাে হে শচীশ। শচীশ তামাক সাজিতে বসিল । তার টিকা যেমন ধরিতে লাগিল। আমিও তেমনি জ্বলিতে লাগিলাম। কোথায় যে বসি ভাবিয়া পাইলাম না। আসবাবের মধ্যে এক তক্তপোশ, তার উপরে স্বামীজির বিছানা পাতা। সেই বিছানার এক পাশে বসাটা অসংগত মনে করি না— কিন্তু কী জানি— (ल शशिा उठिल ना, प्रलछाल कछ लैीgाश्शी श्लिोभ । দেখিলাম, স্বামীজি জানেন আমি রায়চাঁদ-প্রেমচাঁদের বৃত্তিওয়ালা। বলিলেন, বাবা, ডুবুরি মুক্ত তুলিতে সমুদ্রের তলায় গিয়া পৌঁছায়, কিন্তু সেখানেই যদি টিকিয়া যায়। তবে রক্ষা নাই-মুক্তির জন্য তাকে উপরে উঠিয়া হাফ ছাড়িতে হয়। বীচিতে চাও যদি বাপু, তবে এবার বিদ্যাসমুদ্রের তলা হইতে ডাঙার উপরে উঠতে হইবে। প্রেমচাঁদ-রায়চাঁদের বৃত্তি তাে পাইয়াছ, এবার প্রেমচাঁদ-রায়চাঁদের নিবৃত্তিটা একবার দেখো । শচীশ তামাক সাজিয়া তার হাতে দিয়া তার পায়ের দিকে মাটির উপরে বসিল । স্বামী তখনই ‘শচীশের দিকে তীর পা ছড়াইয়া দিলেন। শচীশ ধীরে ধীরে তার পায়ে হাত বুলাইয়া দিতে লাগিল। দেখিয়া আমার মনে এতবড়ো একটা আঘাত বাজিল যে , ঘরে থাকিতে পারিলাম না। বুঝিয়ছিলাম, আমাকে বিশেষ করিয়া ঘা দিবার জন্যই শচীশকে দিয়া এই তামাক-সাজানাে, এই *ों-09*ोनी । স্বামী বিশ্রাম করিতে লাগিলেন, অভ্যাগত সকলের খিচুড়ি খাওয়া হইল। বেলা পাঁচটা হইতে আবার কীর্তন শুরু হইয়া রাত্রি দশটা পর্যন্ত চলিল। " রাত্রে শচীশকে নিরালা পাইয়া বলিলাম, শচীশ, জন্মকাল হইতে তুমি মুক্তির মধ্যে মানুষ, আজ তুমি এ কী বন্ধনে নিজেকে জড়াইলে ?? জ্যাঠামশায়ের মৃত্যু কি এতবড়ো মৃত্যু ? আমার শ্ৰীবিলাস নামের প্রথম দুটাে অক্ষরকে উলটাইয়া দিয়া শচীশ কিছু বা স্নেহের কৌতুকে কিছু বা আমার চেহারার গুণে আমাকে বিশ্ৰী বলিয়া ডাকিত। সে বলিল, বিশ্ৰী, জ্যাঠামশায় যখন বঁচিয়া ছিলেন তখন তিনি আমাকে জীবনের কাজের ক্ষেত্রে মুক্তি দিয়াছিলেন, ছােটাে ছেলে যেমন মুক্তি পায় খেলার আঙিনায় ; জ্যাঠামশায়ের মৃত্যুর পরে তিনি আমাকে মুক্তি দিয়াছেন। রসের সমুদ্রে, ।