পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৫৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চতুরঙ্গ 889 তারা কাদায় তৈরি খেলার পুতুল নয়, আবার সুরে তৈরি বীণার ঝংকারমাত্রও নহে। মেয়েরা আমাদের | ত্যাগ করে, কেননা আমাদের মধ্যে না আছে। লুব্ধ লালসার দুর্দান্ত মোহ, না আছে বিভোর ভাবুকতার রঙিন মায়া ; আমরা প্রবৃত্তির কঠিন পীড়নে তাদের ভাঙিয়া ফেলিতেও পারি না, আবার ভাবের তাপে গলাইয়া আপন কল্পনার ছাচে গড়িয়া তুলিতেও জানি না ; তারা যা, আমরা তাদের ঠিক তাই বলিয়াই জানি- এইজন্য তারা যদি-বা। আমাদের পছন্দ করে, ভালোবাসিতে পারে না। আমরাই তাদের সত্যকার আশ্রয়, আমাদেরই নিষ্ঠার উপর তারা নির্ভর করিতে পারে, আমাদের আত্মোৎসর্গ এতই সহজ যে তার কোনো দাম আছে সে কথা তারা ভুলিয়াই যায়। আমরা তাদের কাছে এইটুকুমাত্র। বকশিশ পাই যে, তারা দরকার পড়িলেই নিজের ব্যবহারে আমাদের লাগায়, এবং হয়তো-বা। আমাদের শ্ৰদ্ধাও করে, কিন্তু- যাক, এ-সব খুব সম্ভব ক্ষোভের কথা, খুব সম্ভব এ-সমস্ত সত্য নয়, খুব সম্ভব মল মুষ্টি পাইল সংখ্যাই আমাদের চিত-অন্তত, সে কথা বলিয়া নেিজর সাক্ষৰ দিয়া থাকি । , দামিনী গুরুজির কাছে ঘেঁষে না তার প্রতি তার একটা রাগ আছে বলিয়া ; দামিনী শচীশকে কেবলই এড়াইয়া চলে তার প্রতি তার মনের ভাব ঠিক উলটা রকমের বলিয়া। কাছাকাছি আমিই একমাত্র মানুষ যাকে লইয়া রাগ বা অনুরাগের কোনো বালাই নাই। সেইজন্য দামিনী আমার কাছে তার সেকালের কথা, একালের কথা, পাড়ায় কবে কী দেখিল কী হইল সেই সমস্ত সামান্য কথা, সুযোগ পাইলেই অনর্গল বকিয়া যায়। আমাদের দােতলার ঘরের সামনে যে খানিকটা ঢাকা ছাদ আছে । সেইখানে বসিয়া জাতি দিয়া সুপারি। কাটিতে কাটিতে দামিনী যাহা-তাহা বকে- পৃথিবীর মধ্যে এই অতি সামান্য ঘটনােটা যে আজকাল শচীশের ভাবে-ভোলা চোখে এমন করিয়া পড়িবে তাহা আমি মনে করিতে পারিতাম না। ঘটনাটা হয়তো সামান্য না হইতে পারে, কিন্তু আমি জানিতাম, শচীশ যে মুল্লুকে বাস করে সেখানে ঘটনা বলিয়া কোনো উপসৰ্গই নাই ; সেখানে হ্রাদিনী ও সন্ধিনী ও যোগমায়া যাহা ঘটাইতেছে সে একটা নিত্যলীলা, সুতরাং তােহা ঐতিহাসিক নহে- সেখানকার চিরযমুনাতীরের চিরাধীর সমীরের বঁাশি যারা শুনিতেছে তারা যে আশপাশের অনিত্য ব্যাপার চোখে কিছু দেখে বা কানে কিছু শোনে হঠাৎ তাহা মনে হয় না। অন্তত গুহা হইতে ফিরিয়া আসার পূর্বে শচীশের চোখ-কান ইহা অপেক্ষা অনেকটা বোজা ছিল । আমারও একটু ত্রুটি ঘটিতেছিল। আমি মাঝে মাঝে আমাদের রসালোচনার আসরে গরহাজির হইতে শুরু করিয়াছিলাম। সেই ফাক শচীশের কাছে ধরা পড়িতে লাগিল। একদিন সে আসিয়া দেখিল, গােয়ালাবাড়ি হইতে এক ভীড় দুধ কিনিয়া আনিয়া দামিনীর পােষা বেজিকে খাওয়াইবার জন্য তাঁর পিছনে ছুটিতেছি। কৈফিয়তের হিসাবে এ কাজটা নিতান্তই আচল, সভাভঙ্গ পর্যন্ত এটা মুলতুবি রাখিলে লোকসান ছিল না, এমন-কি, বেজির ক্ষুধানিবৃত্তির ভার স্বয়ং বেজির পরে রাখিলে জীবে দয়ার অত্যন্ত ব্যত্যয় হইত না। অথচ নামে রুচির পরিচয় দিতে পারিতাম। তাই হঠাৎ শচীশকে দেখিয়া মুম্বইতে ইল। উদ্ভট সৌজন্য রয়াে আছফােল উল্পে পায় সরিয়া যাবার চেষ্ট্র কিন্তু, আশ্চর্য দামিনীর ব্যবহার। সে একটুও কুষ্ঠিত হইল না ; বলিল, কোথায় যান শ্ৰীবিলাসবাবু ? আমি মাথা চুলকাইয়া বলিলাম, একবারদামিনী বলিল, উহাদের গান এতক্ষণে শেষ হইয়া গেছে। আপনি বসুন-না। শচীশের সামনে দামিনীর এই প্রকার অনুরোধে আমার কান দুটাে বা বা করিতে লাগিল। দামিনী কহিল, বেজিটাকে লইয়া মুশকিল হইয়াছে- কাল রাত্রে পাড়ার মুসলমানদের বাড়ি হইতে ও একটা মুরগি চুরি করিয়া খাইয়াছে। উহাকে ছাড়া রাখিলে চলিবে না। শ্ৰীবিলাসবাবুকে বলিয়াছি একটা বড়ো দেখিয়া বুড়ি কিনিয়া আনিতে, উহাকে চাপা দিয়া রাখিতে হইবে। ] বেজিকে দুধ খাওয়ানাে, বেজির কুড়ি কিনিয়া আনা প্রভৃতি উপলক্ষে শ্ৰীবিলাসবাবুর আনুগত্যটা