পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৬১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8(?の রবীন্দ্র-রচনাবলী শচীশ বলিল, আমরা ঠিক করিয়াছি, তুমি যদি কোনাে আত্মীয়ার কাছে গিয়া থাক তবে আমরা খরচপত্রের বন্দোবস্ত করিয়া দিব | श | আমি ঠিক করি নাই । তোমাদের কোনো ভক্ত-বা এক মতলবে এক বন্দোবস্ত করিবেন, কোনো ভক্ত-বা। আর-এক মতলবে আর-এক বন্দোবস্ত করিবেন— মাঝখানে আমি কি তোমাদের দশ-পাঁচিশের ঘুটি ? শচীশ অবাক হইয়া চাহিয়া রহিল । দামিনী কহিল, আমাকে তোমাদের ভালো লাগিবে বলিয়া নিজের ইচ্ছায় তোমাদের মধ্যে আমি আসি নাই । আমাকে তোমাদের ভালো লাগিতেছে না বলিয়া তোমাদের ইচ্ছায় আমি নড়িব না । বলিতে বলিতে মুখের উপর দুই হাত দিয়া তাঁর আঁচল চাপিয়া সে কাদিয়া উঠিল, এবং তাড়াতাড়ি ঘরের মধ্যে ছুটিয়া গিয়া দরজা বন্ধ করিয়া দিল । সেদিন শচীশ আর কীর্তন শুনিতে গেল না । সেই ছাদে মাটির উপরে চুপ করিয়া বসিয়া রহিল । সেদিন দক্ষিণহাওয়ায় দূর সমুদ্রের ঢেউয়ের শব্দ পৃথিবীর বুকের ভিতরকার একটা কান্নার মতো নক্ষত্ৰলোকের দিকে উঠিতে লাগিল । আমি বাহির হইয়া গিয়া অন্ধকারে গ্রামের নির্জন রাস্তার মধ্যে 8 গুরুজি আমাদের দুজনকে যে রসের স্বৰ্গলোকে বধিয়া রাখিবার চেষ্টা করিলেন, আজ মাটির পৃথিবী তাঁহাকে ভাঙিবার জন্য কোমর বাধিয়া লাগিল । এতদিন তিনি রূপকের পাত্রে ভাবের মদ কেবলই আমাদিগকে ভরিয়া ভরিয়া পান করাইয়াছেন, এখন রূপের সঙ্গে রূপকের ঠোকাঠুকি হইয়া পাত্রটা মাটির উপরে কত হইয়া পড়িবার জো হইয়াছে | আসন্ন বিপদের লক্ষণ তার অগোচর রহিল। • | শচীশ আজকাল কেমন-এক-রকম হইয়া গেছে। যে ঘুড়ির লখ ছিড়িয়া গেছে তারই মতো এখনো হাওয়ায় ভাসিতেছে বটে, কিন্তু পাক খাইয়া পড়িল বলিয়া, আর দেরি নাই। জপে তপে অৰ্চনায় আলোচনায় বাহিরের দিকে শচীশের কামাই নাই, কিন্তু চোখ দেখিলে বোঝা যায় ভিতরে ভিতরে তার পা টেলিতেছে । আর, দামিনী আমার সম্বন্ধে কিছু আন্দাজ করিবার রাস্তা রাখে নাই। সে যতই বুঝিল গুরুজি মনে মনে ভয় এবং শচীশ মনে মনে ব্যথা পাইতেছে ততই সে আমাকে লইয়া আরো বেশি টানাটানি করিতে লাগিল । এমন হইল যে, হয়তো আমি শচীশ এবং গুরুজি বসিয়া কথা চলিতেছে এমন সময় দরজার কাছে আসিয়া দামিনী ডাক দিয়া গেল, শ্ৰীবিলাসবাবু, একবার আসুন তো । শ্ৰীবিলাসবাবুকে কী যে তার দরকার তাও বলে না । গুরুজি আমার মুখের দিকে চান, শচীশ আমার মুখের দিকে চায়, আমি উঠি কি না উঠি করিতে করিতে দরজার দিকে তাকাইয়া ধা করিয়া উঠিয়া বাহির হইয়া যাই । আমি চলিয়া গেলেও খানিকক্ষণ কথাটা চালাইবার একটু চেষ্টা চলে, কিন্তু চেষ্টাটা কথাটার চেয়ে বেশি হইয়া উঠে, তার পরে কথাটা বন্ধ হইয়া যায় । এমনি করিয়া ভারি একটা ভাঙাচোরা এলোমেলো কাণ্ড হইতে লাগিল, কিছুতেই কিছু আর আঁট বাধিতে চাহিল না। - আমরা দুজনেই গুরুজির দলের দুই প্রধান বাহন, ঐরাবত এবং উচ্চৈঃশ্রবা বলিলেই হয়— কাজেই আমাদের আশা তিনি সহজে ছাড়িতে পারেন না । তিনি আসিয়া দামিনীকে বলিলেন, মা দামিনী, এবার কিছু দূর ও দুৰ্গম জায়গায় যাইব । এখান হইতেই তোমাকে ফিরিয়া যাইতে হইবে।