পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৭৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8VS রবীন্দ্র-রচনাবলী জীর্ণ বাড়িটার পঁাজারগুলার ফাকের ভিতর দিয়া বার বার বাতাসের তীক্ষ ছুরি বিধিয়া সে কেবলই । একটা জন্তুর মতো হু হু করিয়া চিৎকার করিতেছে। ኴ፡ এইরকম রাতে আমাদের মনের জানলা-দরজার ছিটিকিনিগুলা নড়িয়া যায়, ভিতরে ঝড় ঢুকিয়া পড়ে, ভদ্র আসবাবগুলাকে উলটাপালট করিয়া দেয়, পর্দাগুলা ফরািফর করিয়া কে কোন দিকে যে অদ্ভুত রকম করিয়া উড়িতে থাকে তার ঠিকানা পাওয়া যায় না। আমার ঘুম হইতেছিল না। বিছানায় পড়িয়া পড়িয়া কী-সব কথা ভাবিতেছিলাম তাহা এখানে লিখিয়া কী হইবে। এই ইতিহাসে সেগুলো জরুরি কথা নয়। এমন সময়ে শচীশ একবার তার ঘরের অন্ধকারের মধ্যে বলিয়া উঠিল, কেও ! উত্তর শুনিল, আমি দামিনী। তোমার জানলা খোলা, ঘরে বৃষ্টির ছাট আসিতেছে। বন্ধ করিয়া ईि। বন্ধ করিতে করিতে দেখিল, শচীশ বিছানা হইতে উঠিয়া পড়িয়াছে। মুহূর্তকালের জন্য যেন দ্বিধা করিয়া তার পরে বেগে ঘর হইতে সে বাহির হইয়া গেল। বিদ্যুৎ চমক দিতে লাগিল এবং একটা চাপ বঞ্জ গরগর করিয়া উঠিল। দামিনী অনেকক্ষণ নিজের ঘরের চৌকাঠের পরে বসিয়া রহিল । কেহই ফিরিয়া আসিল না। দমকা হাওয়ার অধৈৰ্য ক্রমেই বাড়িয়া চলিল । দামিনী আর থাকিতে পারিল না, বাহির হইয়া পড়িল । বাতাসে দাড়ানো দায়। মনে হইল, দেবতার পেয়াদাগুলা তাকে ভৎসনা করিতে করিতে ঠেলা দিয়া লইয়া চলিয়াছে। অন্ধকার আজ সচল হইয়া উঠিল। বৃষ্টির জল আকাশের সমস্ত ফাক ভরাট করিবার জন্য প্ৰাণপণে লাগিয়াছে। এমনি করিয়া বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ড ডুবাইয়া কঁদিতে পারিলে দামিনী বীচিত। হঠাৎ একটা বিদ্যুৎ অন্ধকারটাকে আকাশের এক ধার হইতে আর-এক ধার পর্যন্ত পড়পড় শব্দ করিয়া ছিড়িয়া ফেলিল। সেই ক্ষণিক আলোকে দামিনী দেখিতে পাইল, শচীশ নদীর ধারে দাড়াইয়া। দামিনী প্রাণপণ শক্তিতে উঠিয়া পড়িয়া এক দীেড়ে একেবারে তার পায়ের কাছে আসিয়া পড়িল ; বাতাসের চিৎকার শব্দকে হার মানাইয়া বলিয়া উঠিল, এই তোমার পা ছুইয়া বলিতেছি, তোমার কাছে অপরাধ করি নাই, কেন তবে আমাকে এমন করিয়া শান্তি দিতেছ ? শচীশ চুপ করিয়া দাড়াইয়া রহিল। দামিনী বলিল, আমাকে লাথি মারিয়া নদীর মধ্যে ফেলিয়া দিতে চাও তো ফেলিয়া দাও, কিন্তু তুমি ঘরে চলে । । শচীশ বাড়িতে ফিরিয়া আসিল । ভিতরে ঢুকিয়াই বলিল, র্যাকে আমি খুজিতেছি তীকে আমার বড়ো দরকার- আর-কিছুতেই আমার দরকার নাই। দামিনী, তুমি আমাকে দয়া করো, তুমি আমাকে ত্যাগ করিয়া যাও । দামিনী একটুক্ষণ চুপ করিয়া দাড়াইয়া রহিল। তার পরে বলিল, তাই আমি যাইব । ( পরে আমি দামিনীর কাছে আগাগোড়া সকল কথাই শুনিয়াছি, কিন্তু সেদিন কিছুই জানিতাম না । তাই বিছানা হইতে যখন দেখিলাম। এরা দুজনে সামনের বারান্দা দিয়া আপন আপন ঘরের দিকে গোল তখন মনে হইল, আমার দুর্ভাগ্য বুকের উপর চাপিয়া বসিয়া আমার গলা টিপিয়া ধরিতেছে’ ধড়ফড় করিয়া উঠিয়া বসিলাম, সে রাত্রে আমার ঘুম হইল না। পরের দিন সকালে দামিনীর সে কী চেহারা ! কাল রাত্রে ঝড়ের তাণ্ডবনৃত্য পৃথিবীর মধ্যে কেবল যেন এই মেয়েটির উপরেই আপনার সমস্ত পদচিহ্ন রাখিয়া দিয়া গেছে। ইতিহাসটা কিছুই না জানিয়াও শচীশের উপর আমার ভারি রাগ হইতে লাগিল।