পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৭৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ફક রবীন্দ্র-রচনাবলী আমি বলিলাম, মনে করে-না পাগলই হইয়াছি। পাগল হইলে অনেক কঠিন কথা অতি সহজে মীমাংসা করিবার শক্তি জন্মায়। পাগলামি আরব্য-উপন্যাসের সেই জুতা যা পায়ে দিলে সংসারের হাজার হাজার বাজে কথাগুলো একেবারে ডিঙাইয়া যাওয়া যায়। বাজে কথা ! কাকে তুমি বল বাজে কথা ? এই যেমন, লোকে কী বলিবে, ভবিষ্যতে কী ঘটিবে ইত্যাদি ইত্যাদি । দামিনী বলিল, আর, আসল কথা ? আমি বলিলাম, কাকে বল তুমি আসল কথা ? 7 ܆ এই যেমন আমাকে বিবাহ করিলে তোমার কী দশা হইবে । 下*。 এইটেই যদি আসল কথা হয় তবে আমি নিশ্চিন্ত । কেননা, আমার দশা এখন যা আছে তার চেয়ে খারাপ হইবে না। দশটাকে সম্পূর্ণ ঠাই-বদল করাইতে পারিলেই বীচিতাম, অন্ততপক্ষে পাশ । ফিরাইতে পারিলেও একটুখানি আরাম পাওয়া যায়। আমার মনের ভাব সম্বন্ধে দামিনী কোনোরকম তারো-খবর পায় নাই, সে কথা বিশ্বাস করি না । কিন্তু, এতদিন সে খবরটা তার কাছে দরকারি খবর ছিল না ; অন্তত, তার কোনোরকম জবাব দেওয়া নিম্প্রয়ােজন ছিল। এতদিন পরে একটা জবাবের দাবি উঠিল। দামিনী চুপ করিয়া ভাবিতে লাগিল। আমি বলিলাম, দামিনী, আমি সংসারে অত্যন্ত সাধারণ মানুষদের মধ্যে একজন— এমনকি, তার চেয়েও কম, আমি তুচ্ছ। আমাকে বিবাহ করাও যা না-করাও তা, অতএব তোমার ভাবনা কিছুই নাই | -: দামিনীর চোখ ছলছল করিয়া আসিল । সে বলিল, তুমি যদি সাধারণ মানুষ হইতে তবে কিছুই ভাবিতাম না । আরো খানিকক্ষণ ভাবিয়া দামিনী আমাকে বলিল, তুমি তো আমাকে জান ? আমি বলিলাম, তুমিও তো আমাকে জান । এমনি করিয়াই কথাটা পাড়া হইল। যে-সব কথা মুখে বলা হয় নাই তারই পরিমাণ বেশি। পূর্বেই বলিয়াছি, একদিন আমার ইংরেজি বক্তৃতায় অনেক মন বশ করিয়াছি। এতদিন ফাক পাইয়া তাদের অনেকেরই নেশা ছুটিয়াছে। কিন্তু, নরেন এখনো আমাকে বর্তমান যুগের একটা দৈবলব্ধ জিনিস বলিয়াই জানিত। তার একটা বাড়িতে ভাড়াটে আসিতে মাস-দেড়েক দেরি ছিল। আপাতত সেইখানে আমরা আশ্রয় লইলাম । । প্রথম দিনে আমার প্রস্তাবটা চাকা ভাঙিয়া যে মীেনের গর্তটার মধ্যে পড়িল, মনে হইয়াছিল এইখানেই বুঝি হী এবং না। দুইয়েরই বাহিরে পড়িয়া সেটা আটক খাইয়া গেল— অন্তত অনেক মেরামত এবং অনেক হেঁইহঁই করিয়া যদি ইহাকে টানিয়া তোলা যায় । কিন্তু, অভাবনীয় পরিহাসে মনােবিজ্ঞানকে ফাকি দিবার জন্যই মনের সৃষ্টি । সৃষ্টিকর্তার সেই আনন্দের উচ্চহাস্য এবারকার ফায়ুনে এই ভাড়াটে বাড়ির দেয়ালকাটার মধ্যে বার বার ধ্বনিয়া ধ্বনিয়া উঠিল । আমি যে একটা-কিছু, দামিনী এতদিন সে কথা লক্ষ করিবার সময় পায় নাই ; বােধ করি আর-কোনো দিক হইতে তার চোখে বেশি একটা আলো পড়িয়াছিল। এবারে তার সমস্ত জগৎ সংকীর্ণ হইয়া সেইটুকুতে আসিয়া ঠেকিল যেখানে আমিই কেবল একলা। কাজেই আমাকে সম্পূর্ণ চোখ মেলিয়া দেখা ছাড়া আর উপায় ছিল না । আমার ভাগ্য ভালো, তাই ঠিক এই সময়টাতেই দামিনী আমাকে যেন প্রথম দেখিল । রসের তানে বাতাসে আগুন লাগিয়াছে। “তোমার চরণে আমার পরানে লাগিল প্রেমের ফাসি’। এই পদের শিখা নূতন নূতন আখরে স্মৃলিঙ্গ বর্ষণ করিয়াছে। তবু পর্দা পুড়িয়া যায় নাই। কিন্তু, কলিকাতার এই গলিতে এ কী হইল! ঘেঁষাৰ্ঘেষি ঐ বাড়িগুলো চারিদিকে যেন পারিজাতের ফুলের মতো ফুটিয়া উঠিল। বিধাতা তার বাহাদুরি দেখাইলেন বটে ! এই ইটকািঠগুলোকে তিনি তীর