পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৮৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ঘরে-বাইরে বিমলার আত্মকথা মা গো, আজ মনে পড়ছে তোমার সেই সিথের সিদূর, সেই লাল-পেড়ে শাড়ি, সেই তোমার দুটি । চোখ- শান্ত, স্নিগ্ধ, গভীর। সে যে দেখেছি। আমার চিত্তাকাশে ভোরবেলাকার অরুণরাগরেখার মতো। আমার জীবনের দিন যে সেই সোনার পাথেয় নিয়ে যাত্রা করে বেরিয়েছিল। তার পরে ? পথে কালো মেঘ কি ডাকাতের মতো ছুটে এল ? সেই আমার আলোর সম্বল কি এক কণাও রাখল না ? কিন্তু জীবনের ব্ৰাহ্মমুহূর্তে সেই যে উষাসতীর দান, দুর্যোগে সে ঢাকা পড়ে, তবু সে কি নষ্ট হবার ? আমাদের দেশে তাকেই বলে সুন্দর যার বর্ণ গীের । কিন্তু যে আকাশ আলো দেয় সে যে নীল। আমার মায়ের বর্ণ ছিল শামলা, তীর দীপ্তি ছিল পুণ্যের। তীর রূপ রূপের গর্বকে লজ্জা দিত। আমি মায়ের মতো দেখতে এই কথা সকলে বলে | তা নিয়ে ছেলেবেলায় একদিন আয়নার উপর রাগ করেছি। মনে হত আমার সর্বাঙ্গে এ যেন একটা অন্যায়- আমার গায়ের রঙ, এ যেন আমার আসল রঙ নয়, এ যেন আর-কারও জিনিস, একেবারে আগাগোড়া ভুল । সুন্দরী তো নই, কিন্তু মায়ের মতো যেন সতীর যশ পাই দেবতার কাছে একমনে এই বর চাইতুম | বিবাহের সম্বন্ধ হবার সময় আমার শ্বশুরবাড়ি থেকে দৈবজ্ঞ এসে আমার হাত দেখে বলেছিল, এ মেয়েটি সুলক্ষণা সতীলক্ষ্মী হবে। মেয়েরা সবাই বললে, তা হবেই তো, বিমলা যে ওর মায়ের মতো দেখতে | রাজার ঘরে আমার বিয়ে হল। র্তাদের কোন কালের বাদশাহের আমলের সম্মান। ছেলেবেলায় রূপকথার রাজপুত্রের কথা শুনেছি, তখন থেকে মনে একটা ছবি আঁকা ছিল । রাজার ঘরের ছেলে, দেহখানি যেন চামেলি ফুলের পাপড়ি দিয়ে গড়া, যুগযুগান্তর যে-সব কুমারী শিবপূজা করে এসেছে তাদেরই একাগ্ৰ মনের কামনা দিয়ে সেই মুখ যেন তিলে তিলে তৈরি। সে কী চোখ, কী নাকি ! তরুণ গোফের রেখা ভ্রমরের দুটি ডােনর মতো, যেমন কালো, তেমনি কোমল। । স্বামীকে দেখলুম, তার সঙ্গে ঠিক মেলে না। এমন-কি, তার রঙ দেখলুম। আমারই মতো। নিজের রূপের অভাব নিয়ে মনে যে সংকোচ ছিল সেটা কিছু ঘুচল বটে, কিন্তু সেইসঙ্গে একটা দীর্ঘনিশ্বাসও পড়ল। নিজের জন্যে লজ্জায় নাহয় মরেই যৌতুম, তবু মনে মনে যে রাজপুত্রটি ছিল তাকে একবার চােখে চোখে দেখতে পেলুম না কেন ? কিন্তু রূপ যখন চােখের পাহারা এড়িয়ে লুকিয়ে অন্তরে দেখা দেয় সেই বুঝি ভালো। তখন সে যে ভক্তির অমরাবতীতে এসে দাঁড়ায়, সেখানে তাকে কোনাে সাজ করে আসতে হয় না। ভক্তির আপনি সৌন্দর্যে সমস্তই কেমন সুন্দর হয়ে ওঠে সে আমি ছেলেবেলায় দেখেছি। মা যখন বাবার জন্যে বিশেষ করে ফলের খোসা ছাড়িয়ে সাদা পাথরের রেকবিতে জলখাবার গুছিয়ে দিতেন, বাবার জন্যে পানগুলি বিশেষ করে কেওড়া-জলের-ছিাট-দেওয়া কাপড়ের টুকরোয় আলাদা জড়িয়ে রাখতেন, তিনি খেতে বসলে তালপাতার পাখা নিয়ে আস্তে আস্তে মাছি তাড়িয়ে দিতেন, তার সেই লক্ষ্মীর হাতের আদর, তার হৃদয়ের সেই সুধারসের ধারা কোন অপরূপ রূপের সমুদ্রে গিয়ে ঝাপ দিয়ে পড়ত সে যে আমার সেই ছেলেবেলাতেও মনের মধ্যে বুঝতুম।