পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৮৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ঘরে বাইরে 8ዓፄ আমার মেজো জা অন্য ধরনের ছিলেন। তঁর বয়স অল্প, তিনি সাত্ত্বিকতার ভড়ং করতেন না। বরঞ্চ তার কথাবার্তা-হাসিঠাট্টীয় কিছু রসের বিকার ছিল। যে-সব যুবতী দাসী তীর কাছে রেখেছিলেন তাদের রকম-সকম একেবারেই ভালো নয়। তা নিয়ে কেউ আপত্তি করবার লোক ছিল না, কেননা এ বাড়ির ঐরকমই দস্তুর । আমি বুঝতুম আমার স্বামী যে অকলঙ্ক আমার এই বিশেষ সৌভাগ্য র্তার কাছে অসহ্য । তাই তার দেওরের যাতায়াতের পথে ঘাটে নানারকম ফাদ পেতে রাখতেন । এই কথাটা কবুল করতে আমার সব চেয়ে লজ্জা হয় যে, আমার অমন স্বামীর জন্যেও মাঝে মাঝে আমার মনে ভয়-ভাবনা চুকত । এখানকার হাওয়াটাই যে ঘোলা, তার ভিতর দিয়ে স্বচ্ছ জিনিসকেও স্বচ্ছ বোধ হয় না। আমার মেজো জা মাঝে মাঝে এক-এক দিন নিজে রোধে-বেড়ে দেওরকে আদর করে খেতে ডাকতেন। আমার ভারি ইচ্ছে হত, তিনি যেন কোনো ছুতো করে বলেন, না, আমি যেতে পারব না।— যা মন্দ তার তো একটা শাস্তি পাওনা আছে ? কিন্তু, ফি বারেই যখন তিনি হাসিমুখে নিমন্ত্রণ রাখতে যেতেন আমার মনের মধ্যে একটু কেমন- সে আমার অপরাধ- কিন্তু কী করব, আমার মন মানত না— মনে হত এর মধ্যে পুরুষমানুষের একটু চঞ্চলতা আছে। সে সময়টাতে আমার অন্য সহস্ৰ কাজ থাকলেও কোনাে একটা ছুতো করে আমার মেজো জায়ের ঘরে গিয়ে বসতুম। মেজো জা হেসে হেসে বলতেন, বাস রে, ছোটােরানীর একদণ্ড চোখের আড়াল হবার জো নেই- একেবারে কড়া পাহারা ! বলি, আমাদেরও তো একদিন ছিল, কিন্তু এত করে আগলে রাখতে শিখিনি। : আমার স্বামী ঐদের দুঃখটাই দেখতেন, দোষ দেখতে পেতেন না। আমি বলতুম, আচ্ছা, নাহয় যত দোষ সবই সমাজের, কিন্তু অত বেশি দয়া করবার দরকার কী ? মানুষ নাহয় কিছু কষ্টই পেলে, তাই বলেই কি- কিন্তু তীর সঙ্গে পরিবার জো নেই। তিনি তর্ক না করে একটুখানি হাসতেন। বোধ হয় আমার মনের মধ্যে যে একটুখানি কাটা ছিল সেটুকু তীর অজানা ছিল না। আমার রাগের সত্যিকার ঝাজটুকু সমাজের উপরেও না, আর-কারও উপরেও না, সে কেবল- সে আর বলব না। স্বামী একদিন আমাকে বোঝালেন- তোমার এই যে-সমস্তকে ওরা মন্দ বলছে যদি সত্যিই এগুলিকে মন্দ জানত তা হলে এতে ওদের এত রাগ হত না । তা হলে এমন অন্যায় রাগ কিসের জন্যে ? অন্যায় বলব কেমন করে ? ঈর্ষা জিনিসটার মধ্যে একটি সত্য আছে, সে হচ্ছে এই যে, যা-কিছু সুখের সেটি সকলেরই পাওয়া উচিত ছিল। তা, বিধাতার সঙ্গে ঝগড়া করলেই হয়, আমার সঙ্গে কেন ? বিধাতাকে যে হাতের কাছে পাওয়া যায় না । তা ওঁরা যা পেতে চান তা নিলেই হয়। তুমি তো বঞ্চিত করতে চাও না। পরুন-না শাড়ি-জ্যাকেট গয়না জুতো-মোজা, মেমের কাছে পড়তে চান তো সে তো ঘরেই আছে, আর বিয়েই যদি করতে চান তুমি তো বিদ্যাসাগরের মতো অমন সাতটা সাগর পেরোতে পার তোমার এমন সম্বল আছে। ঐ তো মুশকিল— মন যা চায় তা হাতে তুলে দেবার জো নেই। তাই বুঝি কেবল ন্যাকামি করতে হয়, যেন যেটা পাই নি সেটা মন্দ, অথচ অন্য কেউ পেলে সর্বশরীর জুলতে থাকে । যে মানুষ বঞ্চিত এমনি করেই সে আপনার বঞ্চনার চেয়ে বড়ো হয়ে উঠতে চায়— ঐ তার সাস্তুনা | যাই বল তুমি, মেয়েরা বড়ো ন্যাকা। ওরা সত্যি কথাকে কবুল করতে চায় না, ছল করে। তার মানে ওরা সব চেয়ে বঞ্চিত । এমনি করে উনি যখন বাড়ির মেয়েদের সব রকম ক্ষুদ্রতাই উড়িয়ে দিতেন। আমার রাগ হত। সমাজ কী হলে কী হতে পারত সে-সব কথা কয়ে তো কোনো লাভ নেই, কিন্তু পথে ঘাটে চারিদিকে এই-যে কাটা গজিয়ে রইল, এই-যে বঁকা কথার টিটকারী, এই-যে পেটে এক মুখে এক, একে দয়া করতে পারা যায় না । ।