পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৯০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ঘরে-বাইরে 8. ভালোবাসা সার্থক হবে । পরিচয় তোমার হয়তো বাকি থাকতে পারে, কিন্তু আমার কিছুই বাকি নেই। বেশ তো, আমারই যদি বাকি থাকে সেটুকু পূরণ করেই দাও-না কেন ? এ কথা নানা রকম আকারে বার বার উঠেছে। তিনি বলতেন, যে পেটুক মাছের ঝোল ভালোবাসে সে মাছকে কেটেকুটা সঁাৎলে সিদ্ধ করে মসলা দিয়ে নিজের মনের মতোটি করে নেয়, কিন্তু যে লোক মাছকেই সত্য ভালোবাসে সে তাকে পিতলের হাঁড়িতে রোধে পাথরের বাটিতে ভর্তি করতে চায় নাসে তাকে ছাড়া জলের মধ্যেই বশ করতে পারে তাে ভালো, না পারে তাে ডাঙায় বসে অপেক্ষা করে- তার পরে যখন ঘরে ফেরে তখন এইটুকু তার সাস্তুনা থাকে যে, যাকে চাই তাকে পাই নি, কিন্তু নিজের শখের বা সুবিধার জন্য তাকে ছেটে ফেলে নষ্ট করি নি। আস্ত পাওয়াটাই সব চেয়ে ভালো, নিতান্তই যদি তা সম্ভব না হয় তবে আস্ত হারানোটাও ভালো । এসব কথা আমার একেবারেই ভালো লগত না, কিন্তু সেইজনেই যে তখন বের হইনি তা নয়। আমার দিদিশাশুড়ি তখন বেঁচে ছিলেন। তার অমতে আমার স্বামী বিংশ শতাব্দীর প্রায় বিশ-আনা দিয়েই ঘর ভর্তি করে তুলেছিলেন, তিনিও সয়েছিলেন ; রাজবাড়ির বউ যদি পর্দা ঘুচিয়ে বাইরে বেরোেত তা হলেও তিনি সইতেন ; তিনি নিশ্চয় জানতেন এটাও একদিন ঘটবে, কিন্তু আমি ভাবতুম এটা এতই কি জরুরি যে তাকে কষ্ট দিতে যাব। বইয়ে পড়েছি আমরা খাচার পাখি, কিন্তু অন্যের কথা জানি নে, এই খাচার মধ্যে আমার এত ধরেছে যে বিশ্বেও তা ধরে না । অন্তত তখন তো সেইরকমই ভাবতুম | আমার দিদিশাশুড়ি যে আমাকে এত ভালোবাসতেন তার গোড়ার কারণটা এই যে, তার বিশ্বাস আমি আমার স্বামীর ভালোবাসা টানতে পেরেছিলুম সেটা যেন কেবল আমারই গুণ, কিংবা আমার গ্রহনক্ষত্রের চক্রান্ত । কেননা, পুরুষমানুষের ধর্মই হচ্ছে রসাতলে তলিয়ে যাওয়া। তার অন্য কোনো নাতিকে তার নাতবউরা সমস্ত রূপযেীবন নিয়েও ঘরের দিকে টানতে পারে নি, তারা পাপের আগুনে জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে গেলেন, কেউ তাদের বঁাচাতে পারলে না। তাদের ঘরে পুরুষমানুষের এই মরণের আগুন আমিই নেবালুম এই ছিল তার ধারণা। সেইজন্যেই তিনি আমাকে যেন বুকে করে রেখেছিলেন ; আমার একটু অসুখবিসুখ হলে তিনি ভয়ে কঁািপতেন। আমার স্বামী সাহেবের দােকান থেকে যে-সমস্ত সাজসজ্জা এনে সাজাতেন সে তীর পছন্দসই ছিল না। কিন্তু তিনি ভাবতেন পুরুষমানুষের এমন কতকগুলো শখ থাকবেই যা নিতান্ত বাজে, তাতে কেবলই লোকসান । তাকে ঠেকাতে গেলেও চলবে না, অথচ সে যদি সর্বনাশ পর্যন্ত না পৌঁছয় তবেই রক্ষে। আমার নিখিলেশ বউকে যদি না সাজাত আর-কাউকে সাজাতে যেত। এইজন্যে ফি বারে যখন আমার জন্যে কোনো নতুন কাপড় আসত। তিনি তাই নিয়ে আমার স্বামীকে ডেকে কত ঠাট্টা কত আমোদ করতেন। হতে হতে শেষকালে তারও পছন্দর রঙ ফিরেছিল। কলিযুগের কল্যাণে অবশেষে তীর এমন দশা হয়েছিল যে নাতবউ তাকে ইংরেজি বই থেকে গল্প না বললে তার সন্ধ্যা কাটত না । দিদিশাশুড়ির মৃত্যুর পর আমার স্বামীর ইচ্ছা হল আমরা কলকাতায় গিয়ে থাকি। কিন্তু কিছুতেই আমার মন উঠল না। এ যে আমার শ্বশুরের ঘর, দিদিশাশুড়ি কত দুঃখ কত বিচ্ছেদের ভিতর দিয়ে কত যত্নে একে এতকাল আগলে এসেছেন, আমি সমস্ত দায় একেবারে ঘুচিয়ে দিয়ে যদি কলকাতায় চলে যাই। তবে যে আমাকে অভিশাপ লাগবে- এই কথাই বার বার আমার মনে হতে লাগিল । দিদিশাশুড়ির শূন্য আসন আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। সেই সাধবী আট বছর বয়সে এই ঘরে এসেছেন, আর উনআশি বছরে মারা গেছেন। তার সুখের জীবন ছিল না। ভাগ্য তীর বুকে একটার পর একটা কত বাণই হেনেছে, কিন্তু প্রত্যেক আঘাতেই তার জীবন থেকে অমৃত উছলে উঠেছে। এই বৃহৎ সংসার সেই চোখের জলে গলানো পুণ্যের ধারায় পবিত্র। এ ছেড়ে আমি কলকাতার জঞ্জালের মধ্যে গিয়ে কী করব । আমার স্বামী মনে করেছিলেন, এই সুযোগে আমার দুই জায়ের উপর এখানকার সংসারের কর্তৃত্ব