পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৯৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ঘরে-বাইরে 8br(፩ আমি ঠিক করেছিলুম এ খুব সংযত সাজ এর চেয়ে সাদাসিধা আর-কিছু হতে পারে না। এমন সময় আমার মেজো জা এসে আমার মাথা থেকে পা পর্যন্ত একবার চােখ বুলিয়ে নিলেন। তার পরে ঠোটদুটাে খুব টিপে একটু হাসলেন । আমি জিজ্ঞাসা করলুম, দিদি, তুমি হাসলে যে ? তিনি বললেন, তোর সাজ দেখছি । আমি মনে মনে বিরক্ত হয়ে বললুম, এমনিই কি সাজ দেখলে ? তিনি আর-একবার একটুখানি বাকা হাসি হেসে বললেন, মন্দ হয় নি ছোটােরানী, বেশ হয়েছে। কেবল ভাবছি সেই তোমার বিলিতি দোকানের বুক-কাটা জামােটা পরলেই সাজটা পুরোপুরি হত। । এই বলে তিনি কেবল তার মুখ-চােখ নয়, তার মাথা থেকে পা পর্যন্ত সমস্ত দেহের ভঙ্গি হাসিতে ভরে ঘর থেকে চলে গেলেন। খুব রাগ হল এবং মনে হল সমস্ত-ছেড়েছুড়ে আটপৌরে মোটাগোছের একটা শাড়ি পারি। কিন্তু, সে ইচ্ছা শেষ পর্যন্ত কেন যে পালন করতে পারলুম না তা ঠিক জানি নে । মনে মনে বললুম, আমি যদি বেশ ভদ্ররকম সাজ না করেই সন্দীপবাবুর সামনে বেরোই তা হলে আমার স্বামী রাগ করবেন— মেয়েরা যে সমাজের শ্ৰী। ভেবেছিলুম, সন্দীপবাবু একেবারে খেতে যখন বসবেন তখন তার সামনে বেরোব। সেই খাওয়ানো-কর্মটার আড়ালে প্রথম-দেখার সংকোচ অনেকটা কেটে যাবে। কিন্তু, খাবার তৈরি হতে আজ দেরি হচ্ছে, প্ৰায় একটা বেজে গেছে। তাই আমার স্বামী আলাপ করবার জন্য আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। ঘরে ঢুকে প্রথমটা তার মুখের দিকে চাইতে ভারি লজ্জা ঠেকছিল। কোনােমতে সেটা কাটিয়ে জোর করে বলে ফেললুম, আজ খেতে আপনার দেরি হয়ে গেল । তিনি অসংকোচে আমার পাশের চৌকিতে এসে বললেন, দেখুন, অন্ন তো রোজই একরকম জোটে, কিন্তু অন্নপূর্ণ থাকেন আড়ালে। আজ অন্নপূর্ণা এলেন, অন্ন নাহয় আড়ালেই রইল। যেমন জোর তীর বক্তৃতায় তেমনি ব্যবহারে। একটুও দ্বিধা নেই। সব জায়গাতেই আপন আসনটি অবিলম্বে জিতে নেওয়াই যেন তীর অভ্যাস। কেউ কিছু মনে করতে পারে। এ-সব তর্ক তীর নয়। খুব কাছে এসে বসবার স্বাভাবিক দাবি যেন তার আছে, অতএব এতে যে দোষ দিতে পারে দোষ তারই । আমার লজ্জা হতে লাগল, পাছে সন্দীপবাবু মনে করেন। আমি নেহাৎ একটা সেকেলে জড়পদার্থ। মুখের কথা বেশ জ্বল জ্বল করে উঠবে, কোথাও বাধবে না, এক-একটা জবাব শুনে তিনি মনে মনে আশ্চর্য হয়ে যাবেন, এ আমার কিছুতেই ঘটে উঠল না। ভিতরে ভিতরে ভারি কষ্ট হতে লাগল ; নিজেকে হাজার বার ভৎসনা করে বললুম, কেন ওঁর সামনে এমন হঠাৎ বের হতে গেলুম ! কোনোরকম করে খাওয়ানোটা হয়ে গেলেই আমি তাড়াতাড়ি চলে যাচ্ছিলুম ; তিনি আবার তেমনি নিঃসংকোচে দরজার কাছে এসে আমার পথ আগলে বললেন, আমাকে পেটুক ঠাওরাবেন না, আমি খাওয়ার লোভে এখানে আসি নি । আমার লোভ কেবল আপনি ডেকেছেন বলে। যদি খাওয়ার পরে অমনি পালন তা হলে অতিথিকে ফাকি দেওয়া হবে । * এমন সব কথা অত্যন্ত সহজে অত্যন্ত জোরে না বললে ভারি বন্দসুর লগত । আমার স্বামী যে ওঁর পরম বন্ধু, আমি যে ওঁর ভাজের মতো। আমি যখন নিজের সঙ্গে লড়াই করে সন্দীপবাবুর প্রবল আত্মীয়তার সমোচ্চ ক্ষেত্রে ওঠবার চেষ্টা করছি, আমার স্বামী আমার বিভ্ৰাট দেখে আমাকে বললেন, আচ্ছা, তুমি তা হলে তোমার খাওয়া সেরে চলে এসো। সদীপবাবু বললেন, কিন্তু কথা দিয়ে যান ফাকি দেবেন না। আমি একটু হেসে বললুম, আমি এখনই আসছি। তিনি বললেন, আপনাকে কেন বিশ্বাস করি নে তা বলি। আজ ন বছর হল নিখিলেশের বিয়ে হয়েছে। এই নটি বছর আপনি আমাকে ফাকি দিয়ে এসেছেন। আবার ফের যদি ন বছর করেন তা হলে আর দেখা হবে না । আমিও আত্মীয়তা শুরু করে দিয়ে মৃদুকণ্ঠে বললুম, কেন, তা হলেই বা দেখা হবে না কেন ? তিনি বললেন, আমার কুষ্ঠীতে আছে আমি অল্প বয়সে মরব। আমার বাপ দাদা কেউ ত্ৰিশের