পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৯৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ঘরে-বাইরে 8bra অকল্যাণের বাজুক শঙ্খ, ললাটে লেপিয়া দাও কলঙ্ক, নির্লজ কালো কলুষপঙ্ক বুকে দাও প্রলয়ংকরী ! আজ ধিক থাক সেই ধর্মকে যা হাসতে হাসতে সর্বনাশ করতে জানে না। এই বলে তিনি মেজের উপর দু-বার জোরে লাথি মারলেন- কাপেট থেকে অনেকখানি নিদ্রিত ধুলো চমকে উপরে উঠে পড়ল। দেশে দেশে যুগে যুগে মানুষ যা-কিছুকে বড়ো বলে মেনেছে এক মুহুর্তে তিনি তাকে অপমান করে এমন গীেরবে মাথা বাকিয়ে দাঁড়িয়ে উঠলেন যে তার মুখের দিকে চেয়ে আমার সমস্ত শরীরে কাটা দিয়ে উঠল । আবার হঠাৎ গর্জে উঠলেন, যে আগুন ঘরকে পোড়ায়, যে আগুন বাহিরকে জ্বালায় আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি তুমি সেই আগুনের সুন্দরী দেবতা, তুমি আজ আমাদের সকলকে নষ্ট হবার দুর্জয় তেজ দাও, আমাদের অন্যায়কে সুন্দর করো। এই শেষ কটি কথা তিনি যে কাকে বললেন তা ঠিক বোঝা গেল না । মনে করা যেতে পারত। তিনি যাকে বন্দে মাতরং বলে বন্দনা করেন তাকে, কিংবা দেশের যে নারী সেই দেশলক্ষ্মীর প্রতিনিধিরূপে তখন সেখানে বর্তমান ছিল তাকে । মনে করা যেতে পারত। কবি বাল্মীকি যেমন পাপবুদ্ধির বিরুদ্ধে করুণার আঘাতে এক নিমেষে হঠাৎ প্রথম অনুষ্টুপি উচ্চারণ করেছিলেন তেমনি সন্দীপবাবুও ধর্মবুদ্ধির বিরুদ্ধে নিষ্কারুণ্যের আঘাতে এই কথাগুলি হঠাৎ বলে উঠলেন— কিংবা জনসাধারণের মনোহরণ-ব্যবসায়ে চিরাভ্যস্ত অভিনয়কুশলতার এই একটি আশ্চর্য পরিচয় দিলেন। আরো কিছু বোধ হয় বলতেন, এমন সময়ে আমার স্বামী উঠে তঁর গায়ে হাত দিয়ে আস্তে আস্তে বললেন, সন্দীপ, চন্দ্রনাথবাবু এসেছেন। হঠাৎ চমক ভেঙে ফিরে দেখি সীেমামূর্তি বৃদ্ধ দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ঘরে ঢুকবেন কি না ভাবছেন। অস্তোন্মুখ সন্ধ্যাসূর্যের মতো, তার মুখের জ্যোতি নম্রতায় পরিপূর্ণ। আমাকে আমার স্বামী এসে বললেন, ইনি আমার মাস্টারমশায়। এর কথা অনেকবার তােমাকে বলেছি, একে প্ৰণাম করো। আমি তার পায়ের ধুলো নিয়ে তাকে প্ৰণাম করলুম। তিনি আশীর্বাদ করলেন, মা, ভগবান চিরদিন তোমাকে রক্ষা করুন । 粤 • একদিন আমার মনে বিশ্বাস ছিল ঈশ্বর আমাকে যা দেবেন। আমি তা নিতে পারব। এ পর্যন্ত তার পরীক্ষা হয় নি। এবার বুঝি সময় এল। V. মনকে যখন মনে মনে যাচাই করতুম অনেক দুঃখ কল্পনা করেছি। কখনো ভেবেছি দারিদ্র্য, কখনো জেলখানা, কখনো অসম্মান, কখনো মৃত্যু। এমন-কি, কখনো বিমলের মৃত্যুর কথাও ভাবতে চেষ্টা করেছি। এ-সমস্তই নমস্কার করে মাথায় করে নেব। এ কথা যখন বলেছি বোধ হয় মিথ্যা বলি নি । কেবল একটা কথা কোনোদিন মনে কল্পনাও করতে পারিনি। আজ সেই কথাটা নিয়ে সমস্ত দিন বসে বসে ভাবছি, এও কি সইবে ? মনের ভিতরে কোন জায়গায় একটা কঁটা বিধে রয়েছে। কাজকর্মকরছি, কিন্তু বেদনার অবসান নেই। বােধ হয় যখন ঘুমিয়ে থাকি তখন সেই একটা ব্যথা পােজর কাটতে থাকে। সকালে জেগে উঠেই দেখি দিনের আলোর লাবণ্য শুকিয়ে গেছে। কী ? এ কী ? কী হয়েছে ? এ কালো কিসের কালো ? কোথা দিয়ে আমার সমস্ত পূৰ্ণচাঁদের উপর ছায়া ফেলতে এল ?