পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৯৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

880 রবীন্দ্ররচনাবলী আমার মনের বোধশক্তি হঠাৎ এমন ভয়ানক বেড়ে উঠেছে যে, যে দুঃখ আমার অতীতের বুকের ভিতর সুখের ছদ্মবেশ পরে লুকিয়ে বসে ছিল তার সমস্ত মিথ্যা আজ আমার নাড়ি টেনে টেনে ছিড়ছে, আর যে লজ্জা যে দুঃখ ঘনিয়ে এল-বলে সে যতই প্রাণপণে ঘোমটা টানছে আমার হৃদয়ের সামনে ততই তার আবরু ঘুচে গেল। আমার সমস্ত হৃদয় দৃষ্টিতে ভরে গিয়েছে- যা দেখবার নয়, যা দেখতে চাই নে, তাও বসে বসে দেখছি। আমি চিরদিন ঐশ্বর্যের ফকির মধ্যে এতবড়ো কঙাল হয়ে বসেছিলুম। সে কথা এতকাল ভুলিয়ে রেখে আজ হঠাৎ দিনের পর দিনে, মুহূর্তের পর মুহূর্তে, কথার পর কথায়, দৃষ্টির পর দৃষ্টিতে, সেই আমার প্রতারিত জীবনের দুর্ভাগ্য এমন তিলতিল করে প্রকাশ করবার দিন এল কেন ? যৌবনের এই নটা বছর মাত্র মায়াকে যা খাজনা দিয়েছি জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সত্য সেটাকে সুদে আসলে কড়ায় কড়ায় আদায় করতে থাকবে। ঋণশোধের সম্বল যার একেবারে ফুরোল সব চেয়ে বড়ে ঋণশোধের ভার তারই ঘাড়ে। তবু যেন প্রাণপণে বলতে পারি, হে সত্য, তােমারই জয় হােক । আমার পিসতুত বোন মুনুর স্বামী গোপাল কাল এসেছিল তার মেয়ের বিয়ের সাহায্য চাইতে । সে আমার ঘরের আসবাবগুলোর দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবছিল আমার মতো সুখী জগতে আর কেউ নেই। আমি বললুম, গোপাল, মুনুকে বােলো কাল আমি তার ওখানে খেতে যাব। মুনু আপনার হৃদয়ের অমৃতে গরিবের ঘরটিকে স্বৰ্গ করে রেখেছে। সেই লক্ষ্মীর হাতের অন্ন একবার খেয়ে আসবার জন্যে আমার সমস্ত প্ৰাণ আজ কঁদছে। তার ঘরে অভাবগুলিই তার ভূষণ হয়ে উঠেছে। আজ তাকে একবার দেখে আসি গে।— ওগো পবিত্র, জগতে তোমার পবিত্র পায়ের ধুলো আজও একেবারে নিঃশেষ হয়ে যায় নি । জোর করে অহংকার করে কী করব ? নাহয় মাথা হেঁট করেই বললুম আমার গুণের অভাব আছে । পুরুষের মধ্যে মেয়েরা যেটা সব চেয়ে খোজে আমার স্বভাবে হয়তো সেই জোর নেই। কিন্তু, জোর কি শুধু আস্ফালন, শুধু খামখেয়াল, জোর কি এইরকম অসংকোচে পায়ের তলায়- কিন্তু এ-সমস্ত তর্ক করা কেন ? ঝগড়া করে তো যোগ্যতা লাভ করা যায় না। অযোগ্য, অযোগ্য, অযোগ্য ! নাহয় তাই হল- কিন্তু ভালোবাসার তো মূল্য তাই, সে যে অযোগ্যতাকেও সফল করে তোলে। লুৎফুল্ল পঙ্কতে অলঙ্ক পুরস্কার আছে অযোগের জনেই খিতা কেবল এই ভালোবাসাটুকু (3. একদিন বিমলকে বলেছিলুম তোমাকে বাইরে আসতে হবে । বিমল ছিল আমার ঘরের মধ্যে— সে ছিল ঘরগড়া বিমল, ছোটাে জায়গা এবং ছোটাে কর্তব্যের কতকগুলো বাধা নিয়মে তৈরি । তার কাছ থেকে যে ভালোবাসাটুকু নিয়মিত পাচ্ছিলুম। সে কি তার হৃদয়ের গভীর উৎসের সামগ্ৰী, না সে সামাজিক মুনিসিপালিটির বাম্পের চাপে চালিত দৈনিক কলের জলের বাধা বরাদের মতো ? আমি লোভী ? যা পেয়েছিলুম তার চেয়ে আকাঙক্ষা ছিল আমার অনেক বেশি ? না, আমি লোভী নই, আমি প্রেমিক। সেইজন্যেই আমি তালা-দেওয়া লোহার সিন্দুকের জিনিস চাই নি, আমি তাকেই চেয়েছিলুম। আপনি ধরা না দিলে যাকে কোনােমতেই ধরা যায় না। স্মৃতিসংহিতার পুঁথির কাগজের কাটা ফুলে আমি ঘর সাজাতে চাই নি ; বিশ্বের মধ্যে জ্ঞানে শক্তিতে প্রেমে পূৰ্ণবিকশিত বিমলকে - দেখবার বড়ো ইচ্ছা ছিল। একটা কথা তখন ভাবি নি মানুষকে যদি তার পূর্ণ মুক্তরূপে সত্যরূপেই দেখতে চাই তা হলে তার উপরে একেবারে নিশ্চিত দাবি রাখবার আশা ছেড়ে দিতে হয়। এ কথা কেন ভাবি নি ? স্ত্রীর উপর স্বামীর নিত্য-দখলের অহংকারে ? না, তা নয়। ভালোবাসার উপর একান্ত ভরসা ছিল বলেই ।