পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫০৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8፭sbr রবীন্দ্র-রচনাবলী বৈঠকখানা-ঘরে যখন মক্ষ্মী আসে আমার ঘর থেকে আমি একরকম করে টের পাই । খানিকটা বালা-চুরির খানিকটা এটা-ওটার শব্দ পাওয়া যায়। ঘরের দরজাটা বােধ করি সে একটু অনাবশ্যক জোরে ঘা দিয়েই খোলে। তার পরে বইয়ের আলমারির কাচের পাল্লাটা একটু আঁট আছে, সেটা টেনে খুলতে গেলে যথেষ্ট শব্দ হয়ে ওঠে। বৈঠকখানায় এসে দেখি দরজার দিকে পিছন করে মন্ধী শেলফ থেকে মনের মতো বই বাছাই করতে অত্যন্ত বেশি মনোযোগী। তখন তাকে এই দুরূহ কাজে সাহায্য করবার প্রস্তাব করতেই সে চমকে উঠে আপত্তি করে, তার পরে অন্য প্রসঙ্গ উঠে পড়ে। সেদিন বৃহস্পতিবারের বারবেলায় পূর্বোক্ত রকমের শব্দ লক্ষ্য করেই ঘর থেকে রওনা হয়েছিলুম। পথের মাঝখানে বারান্দায় দেখি এক দরোয়ান খাড়া। তার প্রতি ভূক্ষেপ না করেই আমি চলেছিলুম, এমন সময় সে পথ আগলে বললে, বাবু, ও দিকে যাবেন না। D DSS BDSS S বৈঠকখানা-ঘরে রানীমা আছেন। আচ্ছা, তোমার রানীমাকে খবর দাও যে সন্দীপবাবু দেখা করতে চান। : না, সে হবে না, হুকুম নেই। ভারি রাগ হল, গলা একটু চড়িয়ে বললুম, আমি হুকুম করছি। তুমি জিজ্ঞাসা করে এসো। গতিক দেখে দরোয়ান একটু থমকে গেল। তখন আমি তাকে পাশে ঠেলে ঘরের দিকে এগোলুম। যখন প্রায় দরজার কাছ-বরাবর পৌঁচেছি এমন সময় তাড়াতাড়ি সে কর্তব্য পালন করবার জন্যে ছুটে এসে আমার হাত চেপে ধরে বললে, বাবু, যাবেন না। কী ! আমার গায়ে হাত ! আমি হাত ছিনিয়ে নিয়ে তার গালে এক চড় কষিয়ে দিলুম। এমন সময়ে মক্ষ্মী ঘর থেকে বেরিয়ে এসেই দেখে দরোয়ান আমাকে অপমান করবার উপক্রম করছে। তার সেই মূর্তি আমি কখনো ভুলব না। মন্ধী যে সুন্দরী সেটা আমার আবিষ্কার। আমাদের দেশে অধিকাংশ লোক ওর দিক তাকবে না। লম্বা ছিপছিপে গড়ন, যাকে আমাদের রূপরসজ্ঞ লোকেরা নিন্দে করে বলে “ঢ্যাঙা’। ওর ঐ লম্বা গড়নটিই আমাকে মুগ্ধ করে ; যেন প্রাণের ফোয়ারার ধারা, সৃষ্টিকর্তার হৃদয়গুহা থেকে বেগে উপরের দিকে উচ্ছসিত হয়ে উঠেছে। ওর রঙ শামলা, কিন্তু সে যে ইস্পাতের তলোয়ারের মতো শামলা- কী তেজ আর কী ধার! সেই তেজ সেদিন ওর সমস্ত মুখে চােখে ঝিকমিক করে উঠল। চৌকাঠের উপর দাঁড়িয়ে তর্জনী তুলে রানী বললে, ননকু, চলা যাও। আমি বললুম, আপনি রাগ করবেন না, নিষেধ যখন আছে তখন আমিই চলে যাচ্ছি। মক্ষ্মী কম্পিত্যস্বরে বললে, না, আপনি যাবেন না, ঘরে আসুন। এ তো অনুরোধ নয়, এ হুকুম । আমি ঘরে এসে চৌকিতে বসৈ একটা হাতপাখা নিয়ে হাওয়া খেতে লাগলুম। মক্ষী একটা কাগজের টুকরোয় পেনসিল দিয়ে কী লিখে বেহারাকে ডেকে বললে, বাবুকে দিয়ে এসো। আমি বললুম, আমাকে মাপ করবেন, ধৈর্য রাখতে পারি নি, দরোয়ানটাকে মেরেছি। মক্ষী বললে, বেশ করেছেন । কিন্তু ও বেচারার তো কোনো দোষ নেই, ও তো কর্তব্য পালন করেছে। এমন সময় নিখিল ঘরে ঢুকল। আমি দ্রুত চৌকি থেকে উঠে তার দিকে পিঠ করে জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়ালুম। মন্ধী নিখিলকে বললে, আজ ননকু দরোয়ান সন্দীপবাবুকে অপমান করেছে। নিখিল এমনি ভালোমানুষের মতো আশ্চর্য হয়ে বললে 'কেন' যে আমি আর থাকতে পারলুম না। মুখ ফিরিয়ে তার মুখের দিকে একদৃষ্টিতে তাকালুম ; ভাবলুম সাধুলোকের সত্যের বড়াই স্ত্রীর কাছে মন্ধী বললে, সন্দীপবাবু বৈঠকখানায় আসছিলেন, সে ওঁর পথ আটক করে বললে হুকুম নেই।