পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫১৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ঘরে-বাইরে (OGł নিখিল বললে, এরকম বই নিয়ে যারা সত্য-সত্য ভাবতে চায় তাদের পক্ষে ভালো, যারা ফঁাকি দিতে চায় তাদের পক্ষে বিষ । J আমি বললুম, তার অর্থটা কী ? নিখিল বললে, দেখো, আজকের দিনের সমাজে যে লোক এমন কথা বলে যে, নিজের সম্পত্তিতে কোনো মানুষের একান্ত অধিকার নেই সে যদি নির্লোভ হয় তবেই তার মুখে এ কথা সাজে, আর সে যদি স্বভাবতই চোর হয় তবে কথাটা তার মুখে ঘোর মিথ্যে। প্রবৃত্তি যদি প্রবল থাকে। তবে এ বইয়ের ঠিক মানে পাওয়া যাবে না। r আমি বললুম, প্রবৃত্তিই তো প্রকৃতির। সেই গ্যাসপোস্ট যার আলোতে আমরা এসব রাস্তার খোজ পাই। প্রবৃত্তিকে যারা মিথ্যে বলে তারা চােখ উপড়ে ফেলেই দিব্যদৃষ্টি পাবার দুরাশা করে । , নিখিল বললে, প্রবৃত্তিকে আমি তখনই সত্য বলে মনে মানি যখন তার সঙ্গে-সঙ্গেই নিবৃত্তিকেও সত্য বলি। চোখের ভিতরে কোনো জিনিস গুজে দেখতে গেলে চোখকেই নষ্ট করি, দেখতেও পাই নে। প্রবৃত্তির সঙ্গেই একান্ত জড়িয়ে যারা সব জিনিস দেখতে চায় তারা প্রবৃত্তিকেও বিকৃত করে, अउJक9 (लश्ठ 9ाश भों | ሾ তোমার একটা মানসিক বাবুগিরি ; এইজন্যেই কাজের সময় তুমি বাস্তবকে ঝাপসা দেখো, কোনো কােজ তুমি জোরের সঙ্গে করতে পার না। নিখিল বললে, জোরের সঙ্গে কাজ করাটাকেই আমি কাজ করা বলি নে । তবে ? মিথ্যা তর্ক করে কী হবে ? এ-সব কথা নিয়ে নিস্ফল বকতে গেলে এর লাবণ্য নষ্ট হয় । আমার ইচ্ছে ছিল মক্ষ্মী আমাদের তর্কে যোগ দেয়। সে এ পর্যন্ত একটি কথা না বলে চুপ করে বসে ছিল। আজ হয়তো আমি তার মনটাকে কিছু বেশি নাড়া দিয়েছি, তাই মনের মধ্যে দ্বিধা লেগে গেছে- ইস্কুল-মাস্টারের কাছে পাঠ বুঝে নেবার ইচ্ছে হচ্ছে। কী জানি আজকের মাত্ৰাটা অতিরিক্ত বেশি হয়েছে কি না । কিন্তু বেশ করে নাড়া দেওয়াটা দরকার। চিরকাল যেটাকে অনড় বলে মন নিশ্চিন্ত আছে সেটা যে নড়ে এইটিই গোড়ায় জানা চাই। নিখিলকে বললুম, তোমার সঙ্গে কথা হল ভালেই হল। আমি আর একটু হলেই এ বইটা মক্ষীরানীকে পড়তে দিচ্ছিলুম। নিখিল বললে, তাতে ক্ষতি কী ? ও বই যখন আমি পড়েছি তখন বিমলই বা পড়বে না কেন ? আমার কেবল একটি কথা বুঝিয়ে বলবার আছে ; আজকাল যুরোপ মানুষের সব জিনিসকেই বিজ্ঞানের তরফ থেকে যাচাই করছে, এমনিভাবে আলোচনা চলছে যেন মানুষ-পদার্থটা কেবলমাত্র দেহতত্ত্ব কিংবা জীবতত্ত্ব, কিংবা মনস্তত্ত্ব, কিংবা বড়েজোর সমাজতত্ত্ব। কিন্তু মানুষ যে তত্ত্ব নয়, মানুষ যে সব-তত্ত্বকে নিয়ে সব-তত্ত্বকে ছাড়িয়ে অসীমের দিকে আপনাকে মেলে দিচ্ছে, দোহাই তোমাদের, সে কথা ভুলো না । তোমরা আমাকে বল আমি ইস্কুল-মাস্টারের ছাত্র ; আমি নই, সে তোমরামানুষকে তোমরা সায়ান্সের মাস্টারের কাছ থেকে চিনতে চাও, তোমাদের অন্তরাত্মার কাছ থেকে নয় । আমি বললুম, নিখিল, আজকাল তুমি এমন উত্তেজিত হয়ে আছ কেন ? সে বললে, আমি যে স্পষ্ট দেখছি তোমরা মানুষকে ছোটাে করছ, অপমান করছি। কোথায় দেখছ ? : হাওয়ার মধ্যে, আমার বেদনার মধ্যে। মানুষের মধ্যে যিনি সব চেয়ে বড়ো, যিনি তাপস, যিনি সুন্দর, তাকে তোমরা কঁদিয়ে মারতে চাও ! একি তোমার পাগলামির কথা ! নিখিল হঠাৎ দাড়িয়ে উঠে বললে, দেখো সন্দীপ, মানুষ মরণান্তিক দুঃখ পাবে কিন্তু তবু মরবে না। এই বিশ্বাস আমার দৃঢ় আছে, তাই আমি সব সইতে প্ৰস্তুত হয়েছি, জেনেশুনে, বুঝেসুঝে ।