পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫২৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

&२२ রবীন্দ্র-রচনাবলী । চুপ হয়ে গেল, গান থেমে গেছে। । বিরহে যে মন্দির শূন্য হয় সে মন্দিরের শূন্যতার মধ্যেও বাঁশি বাজে ; কিন্তু বিচ্ছেদে যে মন্দির শূন্য হয় সে মন্দির বড়ো নিস্তব্ধ, সেখানে কান্নার শব্দও বেসুরো শোনায় । । আজ আমার কান্না বেসুরো লাগছে। এ কান্না আমার থামাতেই হবে। আমার এই কান্না দিয়ে বিমলকে আমি বন্দী করে রাখব। এমন কাপুরুষ যেন আমি না হই। ভালোবাসা যেখানে একেবারে। মিথ্যা হয়ে গেছে সেখানে কান্না যেন সেই মিথ্যাকে বাধতে না চায়। যতক্ষণ আমার বেদনা প্রকাশ পাবে ততক্ষণ বিমল একেবারে মুক্তি পাবে না। কিন্তু তাকে আমি সম্পূর্ণ মুক্তি দেব, নইলে মিথ্যার হাত থেকে আমিও মুক্তি পাব না। আজ তাকে আমার সঙ্গে বেঁধে রাখা নিজেকেই মায়ার জালে জড়িয়ে রাখা মাত্র। তাতে কারও কিছুই মঙ্গল নেই, সুখ তো নেই। ছুটি দাও, ছুটি নাও- দুঃখ বুকের মানিক হবে। যদি মিথ্যা থেকে খালাস পেতে 에 * h আমার মনে হচ্ছে যেন এইবার আমি একটা জিনিস বুঝতে পারার কিনারায় এসেছি। স্ত্রীপুরুষের ভালোবাসাটাকে সকলে মিলে ফু দিয়ে দিয়ে তার স্বাভাবিক অধিকার ছাড়িয়ে এত দূর পর্যন্ত তাকে বাড়িয়ে তুলেছি যে, আজ তাকে সমস্ত মনুষ্যত্বের দোহাই দিয়েও বশে আনতে পারছি নে। ঘরের প্ৰদীপকে ঘরের আগুন করে তুলেছি। এখন তাকে আর প্রশ্ৰয় দেওয়া নয়, তাকে অবজ্ঞা করবার দিন এসেছে। প্রবৃত্তির হাতের পূজা পেয়ে পেয়ে সে দেবীর রূপ ধরে দাড়িয়েছে; কিন্তু তার সামনে পুরুষের পীেরুষ বলি দিয়ে তাকে রক্তপান করাতে হবে এমন পূজা আমরা মানব না। সাজে-সজ্জায় লজা-শরমে গানে-গল্পে হাসি-কান্নায় যে ইন্দ্ৰজাল সে তৈরি করেছে তাকে ছিন্ন করতে হবে । কালিদাসের ঋতুসংহার কাব্যের উপর বরাবর আমার, একটা ঘূণা আছে। পৃথিবীর সমস্ত ফুলের সাজি, সমস্ত ফলের ডালি কেবলমাত্র প্ৰেয়সীর পায়ের কাছে পড়ে পঞ্চশরের পূজার উপচার জোগাচ্ছে, জগতের আনন্দলীলাকে এমন করে ক্ষুন্ন করতে মানুষ পারে কী করে ? এ কোন মদের নেশায় কবির চোেখ ঢুলে পড়েছে ? আমি যে মদ এতদিন পান করছিলুম তার রঙ এত লাল নয়, কিন্তু তার নেশা তাে এমনিই তীব্ৰ। এই নেশার ঝোকেই আজ সকাল থেকে গুন গুন করে মরছি— শূন্য মন্দির মোর ! শূন্য মন্দির ! বলতে লজ্জা করে না ? এত বড়ো মন্দির কিসে তোমার শূন্য হল ? একটা মিথ্যাকে মিথ্যা বলে জেনেছি, তাই বলে জীবনের সমস্ত সত্য আজ উজাড় হয়ে গেল ? শোবার ঘরের শেলফ থেকে একটা বই আনতে আজ সকালে গিয়েছিলুম। কতদিন দিনের বেলায় কেমন করে উঠল! সেই আনিলাটিতে বিমলের কেঁচানো শাড়ি পাকানো রয়েছে, এক কোণে তার ছাড়া শেমিজ আর জামা ধোবার জন্য অপেক্ষা করছে। আয়নার টেবিলের উপর তার চুলের কাটা, মাথার তেল, চিরুনি, এসেন্সের শিশি, সেইসঙ্গে সিঁদুরের কীেটােটিও ! টেবিলের নীচে তার ছোট্ট সেই একজোড়া জরি-দেওয়া চটিজুতো— একদিন যখন বিমল কোনোমতেই জুতো পরতে চাইত না সেই সময়ে আমি ওর জন্যে আমার এক লক্ষীেয়ের সহপাঠী মুসলমান বন্ধুর যোগে এই জুতো আনিয়ে দিয়েছিলুম। কেবলমাত্র শোবার ঘর থেকে আর ঐ বারান্দা পর্যন্ত এই জুতো পরে যেতে সে লজ্জায় মরে গিয়েছিল। তার পরে বিমল অনেক জুতো ক্ষয় করেছে, কিন্তু এই চটিজোড়াটি সে আদর করে রেখে দিয়েছে। আমি তাকে ঠাট্টা করে বলেছিলুম, যখন ঘুমিয়ে থাকি লুকিয়ে আমার পায়ের ধুলো নিয়ে তুমি আমার পুজো কর, আমি তোমার পায়ের ধুলো নিবারণ করে আজ আমার এই জাগ্রত দেবতার পুজো করতে এসেছি। বিমল বললে, যাও, তুমি অমন করে বোলো না, তা হলে ককখনো ও