পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৩১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

@Q8 রবীন্দ্র-রচনাবলী যায়। এমন বিষম পরিশ্রম করেও বছরের মধ্যে কেবল কয়েক মাস ছেলেপুলে নিয়ে দু-বেলা দু-মুঠো খাওয়া চলে । তার আহারের নিয়ম এই যে, খেতে বসেই সে একঘটি জল খেয়ে পেট ভরায়, আর তার খাদ্যের মস্ত একটা অংশ হচ্ছে সস্তা দামের বীজে-কলা । বছরে অন্তত চার মাস তার এক বেলার বেশি খাওয়া জোটে না । আমি এক সময়ে একে কিছু দান করতে চেয়েছিলুম। মাস্টারমশায় আমাকে বললেন, তোমার দানের দ্বারা মানুষকে তুমি নষ্ট করতে পারো, দুঃখ নষ্ট করতে পারো না। আমাদের বাংলাদেশে পঞ্চ তো একলা নয় । সমস্ত দেশের স্তনে আজ দুধ শুকিয়ে এসেছে। সেই মাতার দুধ তুমি তো আমন করে টাকা দিয়ে বাইরে থেকে জোগাতে পারবে না । এই-সব কথা ভাববার কথা । স্থির করেছিলুম এই ভাবনাতেই প্ৰাণ দেব। সেদিন বিমলাকে এসে বললুম, বিমল, আমাদের দুজনের জীবন দেশের দুঃখের মূলছেদনের কাজে লাগাব। বিমল হেসে বললে, তুমি দেখছি আমার রাজপুত্র সিদ্ধার্থ, দেখো শেষে আমাকে ভাসিয়ে চলে যেয়ে না | আমি বললুম, সিদ্ধার্থের তপস্যায় তার স্ত্রী ছিলেন না, আমার তপস্যায় স্ত্রীকে চাই । এমনি করে কথাটা হাসির উপর দিয়েই গেল । আসলে বিমল স্বভাবত যাকে বলে মহিলা ও যদিও গরিবের ঘর থেকে এসেছে, কিন্তু ও রানী | ও জানে, যারা নীচের শ্রেণীর, তাদের সুখদুঃখ-ভালোমন্দর মাপকাঠি চিরকালের জন্যেই নীচের দরের ৷ তাদের তো অভাব থাকবেই, কিন্তু সে অভাব তাদের পক্ষে অভাবই নয় । তারা আপনার হীনতার বেড়ার দ্বারাই সুরক্ষিত । যেমন ছোটাে পুকুরের জল আপনার পাড়ির বাধনেই টিকে থাকে। পাড়িকে কেটে বড়ো করতে গেলেই তার জল ফুরিয়ে পাক বেরিয়ে পড়ে। যে আভিজাতের অভিমানে খুব ছোটাে ছােটাে ভাগের মধ্যে ভারতবর্ষ মধ্যেও নিজের মাপ-অনুযায়ী একটা কৌলীন্য এবং স্বাতন্ত্রোর গর্ব স্থান পায়, বিমলের রক্তে সেই অভিমান প্রবল । সে ভগবান মনুর দৌহিত্রী বটে। আমার মধ্যে বোধ হয় গুহক এবং একলব্যের রক্তের ধারাটাই প্রবল ; আজ যারা আমার নীচে রয়েছে তাদের নীচ বলে আমার থেকে একেবারে দূরে জানি আমার নীচের লোক যত নাবিছে ভারতবৰ্ষই নাবিছে, তারা যত মরছে। ভারতবৰ্ষই মরছে ! বিমলকে আমার সাধনার মধ্যে পাই নি । আমার জীবনে আমি বিমলকে এতই প্ৰকাণ্ড করে তুলেছি যে, তাকে না পাওয়াতে আমার সাধনা ছোটাে হয়ে গেছে। আমার জীবনের লক্ষাকে কোণে সরিয়ে দিয়েছি, বিমলকে জায়গা দিতে হবে বলে । তাতে করে হয়েছে এই যে, তাকেই দিনরাত সাজিয়েছি পরিয়েছি শিখিয়েছি, তাকেই চিরদিন প্ৰদক্ষিণ করেছি ; মানুষ যে কত বড়ো, জীবন যে কত মহৎ, সে কথা স্পষ্ট করে মনে রাখতে পারি নি । তবু এর ভিতরেও আমাকে রক্ষা করেছেন আমার মাস্টারমশায় ; তিনিই আমাকে যতটা পেরেছেন বড়োর দিকে বাঁচিয়ে রেখেছেন, নইলে আজকের দিনে আমি সর্বনাশের মধ্যে তলিয়ে যৌতুম। আশ্চর্য ঐ মানুষটি। আমি ওঁকে আশ্চর্য বলছি। এইজন্যে যে, আজকের আমার এই দেশের সঙ্গে কালের সঙ্গে । ওঁর এমন একটা প্ৰবল পার্থক্য আছে। উনি আপনার অন্তর্যামীকে দেখতে পেয়েছেন, সেইজন্যে আর কিছুতে ওঁকে ভোলাতে পারে না । আজ যখন আমার জীবনের দেনাপাওনার হিসাব করি তখন এক দিকে একটা মস্ত ঠিকে-ভুল, একটা বড়ো লোকসান ধরা পড়ে, কিন্তু লোকসান ছাড়িয়ে উঠতে পারে এমন একটি লাভের অঙ্ক আমার জীবনে আছে সে কথা যেন জোর করে বলতে পারি। আমাকে যখন উনি পড়ানো শেষ করেছেন তার পূর্বেই পিতৃবিয়োগ হয়ে আমি স্বাধীন হয়েছি । আমি মাস্টারমশায়কে বললুম, আপনি আমার কাছেই থাকুন, অন্য জায়গায় কাজ করবেন না । তিনি বললেন, দেখো, তোমাকে আমি যা দিয়েছি তার দাম পেয়েছি, তার চেয়ে বেশি যা দিয়েছি তার দাম যদি নিই তা হলে আমার ভগবানকে হাটে বিক্রি করা হবে ।