পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৩৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ঘরে-বাইরে (\ΟΣ করব। আর এও আমার মনে ছিল, আমি যা চাইব। তাকে কেউ ঠেকাতে পারবে না । সেদিন সন্দীপের কাছ থেকে ফিরে এসেই চুল খুলে ফেলে আমি নতুন করে চুল বঁধিলুম। ঘাড়ের থেকে এটে চুলগুলোকে মাথার উপরের দিকে টেনে তুলে আমার মেম আমাকে একরকম খোপা বাঁধতে শিখিয়েছিলেন। আমার স্বামী আমার সেই খোপা খুব ভালোবাসতেন ; তিনি বলতেন, ঘাড় জিনিসটা যে কত সুন্দর হতে পারে তা বিধাতা কালিদাসের কাছে প্রকাশ না করে আমার মতাে অ-কবির কাছে খুলে দেখালেন!! কবি হয়তো বলতেন পদ্মের মৃণাল, কিন্তু আমার কাছে মনে হয় যেন মশাল, তার উর্ধের্ব তোমার কালো খোপার কালো শিখা উপরের দিকে জ্বলে উঠেছে। এই বলে তিনি আমার সেই চুল তোলা ঘাড়ের উপর— হায় রে, সে কথা আর কেন ? তার পরে তঁাকে ডেকে পাঠলুম। আগে এমন ছােটােখাটাে সত্যমিথ্যা নানা ছুতোয় তীর ডাক পড়ত। কিছুদিন থেকে ডাকবার সব উপলক্ষই বন্ধ হয়ে গেছে, বানাবার শক্তিও নেই। নিখিলেশের আত্মকথা পষ্ণুর স্ত্রী যক্ষ্মায় ভুগে ভুগে মরেছে। পঞ্চুকে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। সমাজ হিসেব করে বলেছে, খরচ লাগবে সাড়ে তেইশ টাকা । আমি রাগ করে বললুম, নাই বা করলি প্ৰায়শ্চিত্ত, তোর ভয় কিসের ? সে ক্লান্ত গোরুর মতো তার ধৈর্যভারপূর্ণ চােখ তুলে বললে, মেয়েটি আছে, বিয়ে দিতে হবে। আর, বউয়েরও তো গতি করা চাই । . আমি বললুম, পাপাই যদি হয়ে থাকে, এতদিন ধরে তার প্রায়শ্চিত্ত তো কম হয় নি। সে বললে, আজ্ঞে, কম কী ! ডাক্তার খরচায় জমিজমা কিছু বিক্রি আর বাকি সমস্ত বন্ধক পড়ে গেছে। কিন্তু দান-দক্ষিনে ব্ৰাহ্মণভোজন না হলে তো খালাস পাই নে । তর্ক করে কী হবে । মনে মনে বললুম, যে ব্ৰাহ্মণ ভোজন করে তাদের পাপের প্রায়শ্চিত্ত কবে। হবে ? t একে তো পঞ্চ বরাবরই উপবাসের ধার ঘেঁষে কাটিয়েছে, তার উপরে এই স্ত্রীর চিকিৎসা এবং সৎকার উপলক্ষে সে একেবারে অগাধ জলে পড়ল। এই সময়ে কোনোরকম করে একটা সাস্তুনা পাবার জন্যে সে এক সন্ন্যাসী সাধুর চেলাগিরি শুরু করলে। তাতে হল এই, তার ছেলেমেয়েরা যে খেতে পাচ্ছে না সেইটাে ভুলে থাকবার একটা নেশায় সে ডুবে রইল। বুঝে নিলে সংসারটা কিছুই না ; সুখ যেমন নেই তেমনি দুঃখটাও স্বপ্নমাত্র। অবশেষে একদিন রাত্রে ছেলেমেয়ে চারটিকে ভাঙা ঘরে ফেলে রেখে সে বৈরাগী হয়ে বেরিয়ে চলে গেল।। ২ এ-সব কথা আমি কিছুই জানতুম না। আমার মনটার মধ্যে তখন সুরাসুরের মন্থন চলছিল। মাস্টারমশায় যে পঞ্চর ছেলেমেয়েগুলিকে নিজের বাসায় রেখে মানুষ করছেন সে কথাও আমাকে । জানান নি। তখন তীর নিজের ছেলে তার বউকে নিয়ে রেঙুন চলে গেছে; ঘরে তিনি একলা, তীর আবার সমস্ত দিন ইস্কুল। এমনি করে এক মাস যখন কেটে গেছে তখন একদিন সকালবেলায় পঞ্চ এসে উপস্থিত। তার বৈরাগ্যের ঘোর ভেঙেছে। যখন তার বড়ো ছেলেমেয়ে দুটি তার কোলের কাছে মাটির উপর বসে তাকে জিজ্ঞাসা করলে "বাবা, তুই কোথায় গিয়েছিলি, সাব-ছােটাে ছেলেটি তার কােল দখল করে বসলে, আর সেজো মেয়েটি পিঠের উপর পড়ে তার গলা জড়িয়ে ধরলে, তখন কান্নার পর কান্নাকিছুতে তার কান্না থামতে চায় না। বলতে লাগল, মাস্টারবাবু, এগুলোকে দু-বেলা পেট ভরে খাওয়াব সে শক্তিও নেই, আবার এদের ফেলে রেখে দৌড় মারব সে মুক্তিও নেই, এমন করে বেঁধে মাের কেন ? আমি কী পাপ করেছিলুম ?