পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৪০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ঘরে-বাইরে । 699 ওরা প্রতিদিনই মরণ-বাচনের টানাটানিতে পড়ে ওদের শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত লড়ছে কেবলমাত্র কোনোমতে টিকে থাকবার জন্যে- ওদের কাছে দুটাে পয়সার দাম কত সে তোমরা কল্পনাও করতে পার না- ওদের সঙ্গে তোমাদের তুলনা কোথায় ? জীবনের মহলে বরাবর তোমরা এক কোঠায়, ওরা আর-এক কোঠায় কাটিয়ে এসেছে ; আর আজ তোমাদের দায় ওদের কাধের উপর চাপাতে চাও, তোমাদের রাগের ঝাল ওদের দিয়ে মিটিয়ে নেবে ? আমি তো একে কাপুরুষতা মনে করি । তোমরা নিজে যত দূর পর্যন্ত পার করো, মরণ পর্যন্ত— আমি বুড়োমানুষ, নেতা বলে তোমাদের নমস্কার করে পিছনে পিছনে চলতে রাজি আছি। কিন্তু ঐ গরিবদের স্বাধীনতা দলন করে তোমরা যখন স্বাধীনতার জয়পতাকা আস্ফালন করে বেড়াবে তখন আমি তোমাদের বিরুদ্ধে দাড়াব, তাতে যদি মরতে হয় সেও স্বীকার । 单 তারা প্রায় সকলেই মাস্টারমশায়ের ছাত্র, স্পষ্ট কোনো কটু কথা বলতে পারল না, কিন্তু রাগে তাদের রক্ত গরম হয়ে বুকের মধ্যে ফুটতে লাগল। আমার দিকে চেয়ে বললে, দেখুন, সমস্ত দেশ, আজ যে ব্ৰত গ্ৰহণ করেছে। কেবল আপনি তাতে বাধা দেবেন ? ) আমি বললুম, আমি বাধা দিতে পারি। এমন সাধ্য আমার কী আছে! আমি বরং প্রাণপণে তার আনুকূল্য করব । এম. এ. ক্লাসের ছাত্রটি বঁকা হাসি হেসে বললে, কী আনুকুলাটা করছেন ? ) আমি বললুম, দিশি মিল থেকে দিশি কাপড় দিশি সুতো আনিয়ে আমাদের হাটে রাখিয়েছি ; এমনকি, অন্য এলেকার হাটেও আমাদের সুতো পাঠাই— ফুটবলে উল কিন্তু অথবা আপনার হাট দেিয় নেয় একাছি আপনার দর্শসূত্র rt יא আমি বললুম, সে আমার দোষ নয়, আমার হাটের দোষ নয় ; তার একমাত্র কারণ সমস্ত দেশ তােমাদের ব্ৰত নেয় নি। d 海 মাস্টারমশায় বললেন, শুধু তাই নয়, যারা ব্ৰত নিয়েছে তারা বিব্রত করবারই ব্ৰত নিয়েছে। তোমরা চাও, যারা ব্ৰত নেয় নি। তারাই ঐ সুতো কিনে যারা ব্ৰত নেয় নি এমন লোককে দিয়ে কাপড় বোনাবে, আর যারা ব্ৰত নেয় নি তাদের দিয়ে এই কাপড় কেনাবে। কী উপায়ে ? না তোমাদের গায়ের জোরে আর জমিদারের পেয়াদার তাড়ায়। অর্থাৎ ব্ৰত তোমাদের কিন্তু উপবাস করবে ওরা, আর উপবাসের পারণ করবে তোমরা । , সায়ান্স ক্লাসের ছাত্রটি বললে, আচ্ছ বেশ, উপবাসের কোন অংশটা আপনারাই নিয়েছেন শুনি । মাস্টারমশায় বললেন, শুনবে ? দিশি মিল থেকে নিখিলের সেই সুতো নিখিলকেই কিনতে হচ্ছে, নিখিলই সেই সুতোয় জোলাদের দিয়ে কাপড় বোনাচ্ছে, তীতের ইস্কুল খুলে বসেছে, তার পরে বাবাজির যে-রকম ব্যাবসবুদ্ধি তাতে সেই সুতোয় গামছা যখন তৈরি হবে তখন তার দাম দাড়াবে কিংখাবের টুকরোর মতো, সুতরাং সে গামছা নিজেই কিনে উনি ওঁর বসবার ঘরের পর্দা খাটাবেন, সে পর্দায় ওঁর ঘরের আবরু থাকবে না ; ততদিনে তােমাদের যদি ব্ৰত সাঙ্গ হয় তখন দিশি কারুকার্যের নমুনা দেখে তোমরাই সব চেয়ে চেচিয়ে হাসবে— আর, কোথাও যদি সেই রঙিন গামছার অর্ডার এবং আদর মেলে সে ইংরেজের কাছে । এতদিন ওঁর কাছে আছি, মাস্টারমশায়ের এমনতরো শান্তিভঙ্গ হতে কোনােদিন দেখি নি। আমি বেশ বুঝতে পারলুম, কিছুদিন থেকে ওঁর হৃদয়ের মধ্যে একটা বেদনা ‘নিঃশব্দে জমে আসছে ; সে প্রািমষকে ভালোবান্সে বলে। সেই বেদনাতেই ওঁর ধৈর্যের বাধা ভিতরে ভিতরে ক্ষয় করে w ܐ܀" মেডিকেল কলেজের ছাত্র বলে উঠল, আপনারা বয়সে বড়ো, আপনাদের সঙ্গে তর্ক আমরা করবে: না। তা হলে এক কথায় বলুন, আপনাদের হাট থেকে বিলিতি মাল আপনারা সরাবেন না ? আমি বললুম, না, সরাব না, কারণ, সে মাল আমার নয়।